তুমি যদি মনে করে থাক যে কথায় কথায় তোমার কাছে আমি অনুমতি নিতে ছুটব তাহলে তুমি ভুল করেছ।
ম স্থান ত্যাগ করার উপক্রম করলে, কিন্তু তাকে বাধা দিলে বি, একটা কথা শুনে যাও। ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে কথা কইতে হলে স্যার বলবে, বুঝেছ?
বিদ্রূপ-জড়িত হাসির সঙ্গে উত্তর এল, বুঝেছি, স্যার!
উইলসন নামে যে শিক্ষানবিশ নাবিকটি সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে সমস্ত ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল।
তার সহযোগীকে সে বললে, নতুন সর্দার-খালাসি আর আমাদের প্রধান মেট পরস্পরকে পছন্দ করছে না। একটা গোলমাল বাধবে মনে হচ্ছে।
উইলসনের ধারণা যে ভুল হয়নি, খুব শীঘ্রই তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
কয়েকদিন পরের কথা। ঠিক সাড়ে ছয়টার সময়ে সর্দার-খালাসির কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল প্রধান মেট বি–
ওহে সর্দার! কাল রাতে তোমাকে যে হুকুম দিয়েছিলাম আজ সকালেই তুমি সেটা ভুলে গেছ? সকাল ছয়টার মধ্যে আমি লোকজন লাগিয়ে ডেকটাকে পরিষ্কার করে রাখতে বলেছিলাম। এখন সাড়ে ছয়টা বাজে অথচ ডেক আগের মতোই ময়লা হয়ে পড়ে আছে। ওখানে একটিও লোক নেই–ব্যাপারটা কী? কাল রাতের কথা আজ সকালেই ভুলে গেলে? তোমার স্মৃতিশক্তি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে।
ম ধূমপান করছিল।
সে নির্বিকার চিত্তে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললে, আমি কিছুই ভুলিনি। আমার স্মৃতিশক্তি নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আসল কথা হচ্ছে যে ঘুমটা ভালো হলে কাজটাও ভালো হয়। তাই আমি ওদের আরও ঘণ্টা দুই ঘুমানোর অনুমতি দিয়েছি। ঠিক আটটার সময়ে ওরা কাজে লাগবে।
তুমি অনুমতি দিয়েছ? তুমি অনুমতি দেওয়ার কে? ফের যদি তুমি ওপরচালাকি কর তাহলে তোমাকে আমি সর্দার-খালাসির পদ থেকে খারিজ করে দেব।
তুমি আমায় খারিজ করবে?সর্দার-খালাসির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, ওহে খোকা! যখন তুমি দোলনায় দুলতে দুলতে বোতলের দুধ খাচ্ছ তখন থেকে আমি জাহাজের কাজে লোকজন খাটাচ্ছি, বুঝলে?
ম আরও যেসব কথা বলতে যাচ্ছিল সেগুলো নিশ্চয়ই বি-র পক্ষে খুব সম্মানজনক হত না, কিন্তু বি তাকে আর কথা বলতে দিল না।
সর্দার-খালাসির চোয়ালের উপর সে প্রয়োগ করলে, মুষ্টিবদ্ধ হস্তের নিদারুণ মুষ্টিযোগ!
আচমকা ঘুসি খেয়ে ছিটকে পড়ল ম।
প্রথমে সে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, তারপর বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে সে উঠে দাঁড়াল এবং খেপা ষাঁড়ের মতো গর্জন করে তেড়ে এল প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে।
ম-র শারীরিক শক্তি ছিল বি-র চাইতে অনেক বেশি।
কিন্তু বি পাকা মুষ্টিযোদ্ধা, তার বাঁ-হাতের বজ্রমুষ্টি বারংবার ছোবল মারল প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখে।
দেখতে দেখতে ম-র মুখের উপর ফুটে উঠল তপ্ত রক্তধারার বিচিত্র আলপনা।
ডেকের ওপর ততক্ষণে ভিড় জমিয়েছে নাবিকের দল।ম-র রক্তমাখা মুখের অবস্থা দেখে একজন মন্তব্য করলে, সর্দার-খালাসির হয়ে এসেছে।
কিন্তু ম পোড় খাওয়া মানুষ, এত সহজে সে হার মানতে রাজি হল না।
দুই বাহু বিস্তার করে সে বি-কে জড়িয়ে ধরলে এবং চোখের পলক ফেলার আগেই প্রতিদ্বন্দ্বীর দেহটাকে নিক্ষেপ করলে জাহাজের ডেকের ওপর।
একটা লোহার যন্ত্রের গায়ে বি-র মাথাটা সজোরে ঠোক্কর খেল, দারুণ যাতনায় লুপ্ত হয়ে এল তার চেতনা।
আচ্ছন্ন অবস্থায় সে দেখতে লাগল রাশি রাশি সরষে ফুল!
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বি যখন উঠে দাঁড়াল, তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী মুখের রক্ত মুছতে–ব্যস্ত। দুই শত্রু পরস্পরকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করলে, তারপর বি বললে, লড়াই শেষ হয়নি। আমরা আবার লড়ব। দুজন সহযোগী আর একজন মধ্যস্থ এখানে থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে একজন লম্বা হয়ে শুয়ে না-পড়বে ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই চলবে রাজি?
কাধ ঝাঁকিয়ে ম বললে, ঠিক আছে।
জাহাজের খালাসিরা মহা উৎসাহে কাজে লেগে গেল। বিকালের মধ্যেই ডেকের ওপর দড়িদড়া লাগিয়ে একটা সুন্দর মুষ্টিযুদ্ধের রিং বা আখড়া বানিয়ে ফেলল তারা।
সবাই প্রস্তুত। এবার লড়াইটা লাগলে হয়। অকস্মাৎ মূর্তিমান বিঘ্নের মতো অকুস্থলে উপস্থিত হলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন।
চারদিকে চোখ বুলিয়ে তিনি বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, কী ব্যাপার? সার্কাস-টার্কাস হবে নাকি?
মেট সমস্ত ব্যাপারটা ক্যাপ্টেনকে বুঝিয়ে বললে।
সব শুনে ক্যাপ্টেন সাহেব একটি বক্তৃতা দিলেন।
সেই দীর্ঘ বক্তৃতার সারমর্ম হচ্ছে যে ঘুসির জোরে যারা মানুষের ভ্রম সংশোধন করতে চায়, তাদের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারছেন না এবং তার জাহাজে এই ধরনের বর্বরতা তিনি। বরদাস্ত করবেন না কিছুতেই।
ক্যাপ্টেনের কথার ওপর কথা চলে না। লড়াই বন্ধ হয়ে গেল। কয়েকদিন পরেই জাহাজের উপর হানা দিল প্রবল ঝটিকা। ক্যাপ্টেন ডেকের ওপর ছিলেন, জাহাজের একটা বৃহৎ অংশ ঝড়ের ধাক্কায় ভেঙে পড়ল তার মাথার ওপর এবং ওই ভাঙাচোরা অংশসমেত তার দেহ ছিটকে পড়ল সমুদ্রের জলে।
ক্যাপ্টেনকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। উত্তাল তরঙ্গের বুকে হারিয়ে গেলেন জাহাজের প্রধান অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন জেড।
অন্যান্য খালাসিরা ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। প্রধান মেট বি এবং তার দুই সহকারী ভয়ার্ত নাবিকদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে প্রাণপণে যুদ্ধ করলে ঝড়ের বিরুদ্ধে।
বি-র উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসে সেবার ভরাডুবি থেকে রক্ষা পেল এক্স জাহাজ।