আমাকে মঙ্গল কামনা জানিয়ে মূর্তি হল অদৃশ্য এবং তার অন্তর্ধানের পর আমার ঘুমও ভেঙে গেল। ওই ঘটনার কয়েক মাস পরে আমি মিশর ত্যাগ করেছিলাম। কিন্তু মূর্তির সাবধানবাণী কখনো অগ্রাহ্য করিনি। প্রথমে জেটির উপর কুলির মুখে এবং তারপর ঘোড়ার গাড়ির চালকের কপালের ওপর আমি দেখেছিলাম লাল ও শুষ্ক ক্ষতচিহ্ন, সঙ্গেসঙ্গে সাবধান হয়ে কী করেছি তা তো তুমি জান।
এমিলির দুর্ভাবনা গেল না, উদবিগ্ন কণ্ঠে তিনি বলেন, কিন্তু মাত্র তো দু-বার গেছে। এখনও একটা ফাড়াআছে।
জেমস হাসলেন, না ভয় নেই। বিপদ কেটে গেছে। মিশর ছেড়ে আসার আগে কায়রো শহরেই একদিন লিফট দিয়ে নামতে গিয়ে লিফটম্যানের মুখের ওপর দেখলাম মৃত্যুর স্বাক্ষর রক্তবর্ণ ক্ষতচিহ্ন! আমি তৎক্ষণাৎ থেমে গেলাম এবং আমার সঙ্গে যে বন্ধুটি ছিলেন তাঁকে ধরে রেখে জানালাম আমি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামব, অতএব তাঁকেও আমার সঙ্গী হতে হবে। তোমার মতো বন্ধুটিও আমার ওপর রেগে আগুন হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই এক ভীষণ শব্দ! জানা গেল লিফটের কল বিগড়ে যান্ত্রিক খাঁচাটা হঠাৎ আছড়ে পড়েছে নীচে, লিফটের মধ্যে যারা ছিল তাদের মধ্যে একটি প্রাণীও রক্ষা পায়নি! বন্ধুটি খুব আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলেন আমি কি সত্যিই দুর্ঘটনার কথা অনুমান করতে পেরেছিলাম? আমি অবশ্য তাঁর কৌতূহল নিবারণ করিনি। যাই হোক, বার বার তিনবারই আমি অকালমৃত্যুর আক্রমণ এড়িয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি এবং আশা করছি এইবার বেশ কিছুকাল নিশ্চিন্ত হয়ে এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করতে পারব।
উপরে বর্ণিত কাহিনিটি নিছক গল্প নয়, ঘটনাগুলি বাস্তব জীবনেই ঘটেছিল। তবে স্থান, কাল ও পাত্রপাত্রীদের নাম গোপন করা হয়েছে।
[১৩৮৭]
সবজান্তার শাস্তি
বর্তমান কাহিনির পটভূমি হচ্ছে একটি মালবাহী জাহাজ এবং তরঙ্গ-গর্জিত উত্তাল সমুদ্র।
সমুদ্রযাত্রাকে ভিত্তি করে যে-কাহিনি এখানে পরিবেশিত হচ্ছে, সেটি লিখেছেন একজন খ্যাতনামা ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ও-ব্রায়ান।
ক্যাপ্টেন সাহেব বলছেন ঘটনাটি বর্ণে বর্ণে সত্য। আমরা তার কথা বিশ্বাস করতে পারি। ও-ব্রায়ানের মতো দায়িত্বপূর্ণ কার্যে নিযুক্ত মানুষ ছাপার অক্ষরে গুল মারবেন বলে মনে হয় না। ওই সামুদ্রিক নাটকে যারা অংশগ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তি আজও সশরীরে বর্তমান তাই ক্যাপ্টেন তার লেখার মধ্যে আসল নামগুলো বদলে দিয়েছেন।
–তা বদলান, লোকগুলোর সঠিক কুষ্ঠি-ঠিকুজি দিয়ে আমাদের কী দরকার? আমরা গল্প শুনতে পেলেই খুশি।
আচ্ছা, এবার কাহিনি শুরু করছি—
এক্স জাহাজটা নেহাত ছোটোখাটো নয়, পাকা ২৫০০ টন তার ওজন। ১৯০৫ সালে অক্টোবর মাসে টাকামা অঞ্চলে এসে উক্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন কয়েকজন অভিজ্ঞ নাবিকের প্রয়োজন অনুভব করলেন।
লোক নেওয়া হল।
সর্দার খালাসির পদে নিযুক্ত হল যে লোকটি, তার চেহারাটা সত্যি দর্শনীয় বস্তু–
দেহ পেশিবহুল ও দৃঢ়, মুখ পাথরের মতো কঠিন নির্বিকার, কালো চুলে ঘেরা চওড়া কপালের নীচে একজোড়া কালো চোখের উগ্র দৃষ্টিতে রূঢ়তার প্রলেপ।
নাম তার ম।
বয়স প্রায় চল্লিশ।
ম রূপবান ছিল না। কিন্তু পৌরুষের প্রভাবে ঢাকা পড়েছিল রূপের অভাব। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিল সে। সাধারণ নাবিকরা তার প্রতি আকৃষ্ট হত, উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা তাকে উপেক্ষা দেখাতে সাহস করতেন না। জাহাজের কাজকর্মে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল। সে যদি তার কর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত থেকে নিজের কাজে মনোনিবেশ করত তাহলে ব্যক্তিগত জীবনে সে নিশ্চয়ই উন্নতি করতে পারত।
কিন্তু ম হচ্ছে সবজান্তা মানুষ!
সব বিষয়েই সে ভালো বোঝে এবং অন্য লোকগুলো কিছুই বোঝে না, এই ছিল তার ধারণা।
এই ধারণা পোষণ করে সে যদি ক্ষান্ত থাকত তবে কোনো অসুবিধা ছিল না, কিন্তু পৃথিবীর যাবতীয় মূর্খকে জ্ঞান দেওয়ার গুরুদায়িত্ব সে পালন করত অসীম নিষ্ঠার সঙ্গে!
এক্স জাহাজের কাজে নিযুক্ত হওয়ার পর আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই সে আবিষ্কার করে ফেলল যে ডেকের সাদা রংটা মোটেই ভালো হয়নি!
মাস্তুলের উজ্জ্বল রংটাও অতিশয় আপত্তিজনক মনে হল, তা ছাড়া অন্যান্য কলকবজার বিন্যাসব্যবস্থাও তার মনঃপূত হল না।
পেনসিল কাগজ হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে যাবতীয় দোষত্রুটির বিশদ বিবরণ লিখতে লাগল সে। অবিলম্বে এইসব ত্রুটিবিচ্যুতি সংশোধন করা দরকার! ডেকের ওপর দুজন শিক্ষানবিশ সকৌতুকে তার চালচলন লক্ষ করছিল, কিন্তু কোনো মন্তব্য করার সাহস তাদের ছিল না।
ম-র চেহারার মধ্যে ছিল এমন এক বন্য ব্যক্তিত্বের প্রকাশ যে সাধারণ মানুষ চট করে তার আচরণের প্রতিবাদ করতে সাহস পেত না।
কিন্তু জাহাজের প্রধান মেট বা দ্বিতীয় অধ্যক্ষ বি খুব সাধারণ মানুষ ছিল না। সে যখন দেখল বিনা কারণে কতকগুলি পুরোনো দড়ি বাতিল করে ম নামধারী সর্দার-খালাসি নূতন দড়ি ব্যবহার করতে চাইছে তখন সে বাধা দিল–
মাল বাঁধার কাজ পুরানো দড়িতেই চলবে। নতুন দড়ি শুধু গিয়ার আর নোঙর বাঁধার কাজে ব্যবহার করা হয়। ভবিষ্যতে আমার অনুমতি ছাড়া তুমি নতুন দড়িতে হাত দেবে না।
নতুন দড়ির ফাঁসটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল সর্দার-খালাসি—