সত্যি কথা! তাঁরা দুজন যে নাট্যাগারের উদ্দেশে এখানে এসেছেন, সেই অপেরা-হাউস বেষ্টন করে জ্বলছে এক ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ড!
সমবেত জনতার কাছে অনুসন্ধান করে জেমস জানলেন প্রায় আধঘণ্টা আগে হঠাৎ কোনো অজ্ঞাত কারণে নাট্যশালায় আগুন ধরে যায়।এমন অতর্কিতে এক প্রচণ্ড অগ্নিবন্যা নাট্যাগারে আত্মপ্রকাশ করে যে, দর্শকরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করা সুযোগও পায় না। অনেক হতভাগ্যেরই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে; অনেকে উদ্ধার পেলেও এমনভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়েছে যে তাদের জীবিত থাকার আশা খুব কম। কোনোরকমে প্রাণরক্ষা হলেও ওইসব নরনারীর মুখ ও দেহের ওপর থেকে আগুনের বীভৎস দংশন-চিহ্ন কোনোদিনই মুছে যাবে না। মানুষের স্বাভাবিক সৌন্দর্য থেকে তারা হবে-চিরজীবনের মতো বঞ্চিত…
স্বামীর হাত ধরে হোটেলে ফিরে এলেন মিসেস এমিলি গিলবার্ট। কিছুক্ষণ দুজনের মধ্যে কোনো কথাবার্তা হল না। আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহ রূপ এমিলিকে প্রায় স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। জেমস তাঁর স্ত্রীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মৌনব্রত অবলম্বন করেছিলেন।
অবশেষে প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করলেন এমিলি : জেমস! আজও আমরা অদ্ভুতভাবে রক্ষা পেয়েছি। প্রথম গাড়িটাতে যদি আমরা উঠে পড়তাম তাহলে যথাসময়েই আমরা পৌঁছে যেতাম নাট্যাগারে; এবং ওই ভয়াবহ আগুনের বেড়াজালে পুড়ে আমাদের মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। কিংবা প্রাণে বাঁচলেও সারাজীবন হয়ে থাকতাম মূর্তিমান বীভৎসতার এক কুশ্রী প্রতিচ্ছবি। বলো জেমস, এই অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারটা তুমি নিশ্চয় আগেই জানতে পেরেছিলে?… আমার বিশ্বাস তুমি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, তুমি নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা!… চুপ করে রইলে কেন? আমি তোমার স্ত্রী, আমার কাছে কিছুই তোমার গোপন করা উচিত নয়।
জেমস মুখ তুললেন, না, এমিলি, কিছুই গোপন করব না। তোমাকে আগে বলিনি, কারণ বললেও তুমি হয়তো বিশ্বাস করতে না। আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই তোমার এই ধারণা সত্য নয়, কিন্তু মূর্তিমান অমঙ্গল যখন মৃত্যুদূত হয়ে আমার সামনে আসে তখন আমি তাকে চিনতে পারি। না, কথাটা ঠিক হল না বরং বলতে হবে তখন তাকে চেনার ক্ষমতা আমার ছিল, কিন্তু আজ থেকে সে-ক্ষমতা আর আমার রইল না।
উৎকণ্ঠিত স্বরে এমিলি প্রশ্ন করলেন, কেন? ভবিষ্যতে আবার যদি বিপদ আসে তাহলে কি তুমি জানতে পারবে না?
না, পারব না। কিন্তু জানার প্রয়োজনও আর হবে না। মৃত্যু আরও একবার আমার কাছে আসবে, কিন্তু তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কারণ সেই মৃত্যু হচ্ছে মানুষের। অবশ্যম্ভাবী স্বাভাবিক পরিণতি। তোমার উদবিগ্ন হওয়ার হেতু নেই এমিলি, আমি আরও অনেক দিন বাঁচব।
তাহলে আমার সন্দেহ সত্য? তুমি ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা রাখো?
না, আগেও বলেছি, এখনও বলছি আমি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী নই, ভবিষ্যদ্রষ্টাও নই। শোনো, সব কথা তোমায় খুলে বলছি। আজ থেকে কয়েক বৎসর আগে আমি মিশরে গিয়েছিলাম। তুমি জানো আমি প্রত্নতাত্ত্বিক, প্রাচীন মিশরের একটি কবর খুঁড়ে আমি একটি কফিন হস্তগত করি। কফিনের ভিতর ছিল একটি মমি। এমিলি, তুমি নিশ্চয় জানোমমিকাকে বলে?
জানি। প্রাচীন মিশরীয়রা কোনো অজ্ঞাত উপায়ে মৃতদেহকে সংরক্ষণ করত। বিশেষ ধরনের ঔষধ প্রয়োগ করে তারা মৃতদেহকে কবর দিত।
ওই ওষুধের প্রভাবে মড়ার চামড়া ও মাংস জীর্ণ হয়ে খসে পড়ত না, দেহে প্রাণ না-থাকলেও সেই মৃতদেহ তার জীবন্ত চেহারার প্রতিচ্ছবি হয়ে কবরের মধ্যে বিরাজ করত যুগযুগান্তর ধরে। অবিকৃত সেই মৃতদেহকে মমি বলা হয়।
ঠিক, ওই ধরনের একটা মমি হস্তগত করে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। শবাধার অর্থাৎ কফিনসুদ্ধ মমির দেহটা আমি নিউইয়র্কে নিয়ে যেতে মনস্থ করি। মমিটা যেদিন আমার হাতে এল সেই রাতেই আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নের ভিতর আমার সামনে আবির্ভূত হল এক আশ্চর্য মূর্তি। সেই মূর্তির সর্বাঙ্গ বেষ্টন করে ঝুলছে প্রাচীন মিশরীয় পরিচ্ছদ। তার মুখটা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি; কারণ গোলাকার বলয়ের মতো এক তীব্র আলোকপুঞ্জ অবস্থান করছিল সেই মূর্তির কাঁধের উপর এবং সেই অপার্থিব আলোকপ্রবাহের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল মূর্তির মুখমণ্ডল। সেই অদ্ভুত মূর্তির কাঁধের ওপর থেকে জ্বলন্ত আলোর বলয় ভেদ করে ভেসে এল এক অমানুষিক কণ্ঠস্বর
হে বিদেশি! প্রাচীন মিশরের অমর্যাদা কোরো না। জীবিত মানুষের কাছ থেকে যে বিদায় নিয়েছে, তাকে শান্তিতে বিশ্রাম নিতে দাও। যে কবর খনন করে তুমি কফিনটা নিয়ে এসেছ, সেই কবরের ভিতর আবার তুমি ওটাকে রেখে এসো। আমার কথা শুনলে তোমার মঙ্গল হবে।
পরক্ষণেই মূর্তি অদৃশ্য হল আমার ঘুমও গেল ভেঙে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে আমি স্বপ্নের কথা চিন্তা করলাম। স্বপ্ন বটে, কিন্তু এমন জীবন্ত ও প্রত্যক্ষ স্বপ্নের অনুভূতি আমার জীবনে কখনো হয়নি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পরের দিন স্বপ্নে দৃষ্ট মূর্তির কথা মতো কফিনটা পূর্বোক্ত কবরের মধ্যে রেখে এলাম। সেই রাতে আবার স্বপ্নের মধ্যে সেই মূর্তি আমার সামনে আবির্ভূত হল। স্বপ্নের মধ্যেই শুনলাম সেই গভীর অপার্থিব কণ্ঠস্বর–বিদেশি! আমি খুশি হয়েছি! তোমার অন্যান্য দেশবাসীর মতো তুমি নির্বোধ নও! শোনো, তোমার ভাগ্যে অকালে মৃত্যুযোগ আছে। বার বার তিনবার মৃত্যু তোমাকে আক্রমণ করবে। কিন্তু সাবধান থাকলে অকালমৃত্যু তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। যে-মানুষের মুখের উপর তুমি শুষ্ক রক্তবর্ণ ক্ষতচিহ্ন দেখতে পাবে তার থেকে সর্বদা দূরে থাকবে। জানবে, ওই রক্তবর্ণ ক্ষতচিহ্নের মানুষ হচ্ছে অশরীরী মৃত্যুর শরীরী প্রতিনিধি। আচ্ছা, আজ বিদায় গ্রহণ করছি, তোমার মঙ্গল হোক…।