কিন্তু তবু একটা প্রশ্ন থেকে যায়।
স্বামীর বিসদৃশ ব্যবহারের কোনো সংগত কারণ খুঁজে না-পেলেও জেমসকে নিতান্ত স্বার্থপর নিষ্ঠুর মানুষ বলে ভাবতে পারছিলেন না এমিলি। বিবাহের আগে ও পরে তিনি স্বামীর কাছ থেকে কোনোদিনই খারাপ ব্যবহার পাননি। বরং স্ত্রীর প্রতিটি ইচ্ছা-অনিচ্ছার মর্যাদা যে মানুষ স্নেহের সঙ্গে রক্ষা করে এসেছে সেই লোকটি হঠাৎ এমন অসংগত ব্যবহার করল কেন এই প্রশ্নই বার বার জেগে উঠেছে এমিলির মনের মধ্যে।
আচম্বিতে নববধূর চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে তার কর্ণমূলে প্রবেশ করল এক হকারের উচ্চ কণ্ঠস্বর, টেলিগ্রাম! টেলিগ্রাম! দারুণ খবর! লিংকন জাহাজ ডুবে গেছে! জোর খবর!
এমিলি চমকে উঠলেন।
লিংকন! ওই লিংকন জাহাজেই তো তাদের আমেরিকা যাত্রা করার কথা ছিল।
দারুণ কৌতূহলী হয়ে এমিলি একটা টেলিগ্রাম কিনে ফেললেন এবং খবরের ওপর চোখ . বুলিয়ে তিনি হয়ে পড়লেন স্তম্ভিত!
অপ্রত্যাশিতভাবে সামুদ্রিক ঝটিকার আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে ডুবে গেছে লিংকন জাহাজ! একটিমাত্র যাত্রী সাঁতরে বেঁচেছে, আর সকলেরই হয়েছে সলিলসমাধি!
জেমস চুপচাপ বসে ধূমপান করেছিলেন, হঠাৎ ঝড়ের মতো তার সামনে আবির্ভূত হলেন এমিলি! পরক্ষণেই জেমস দেখলেন তার কোলের ওপর এসে পড়েছে একটি কাগজ, সঙ্গেসঙ্গে তিনি শুনতে পেলেন স্ত্রীর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর–জেমস! জেমস! এই দেখ টেলিগ্রাম! লিংকন জাহাজ ডুবে গেছে!… আমি অকারণে রাগ করেছি, দুঃখ পেয়েছি-তুমি নিশ্চয়ই আসন্ন বিপদের কথা জানতে পেরেছিলে! কিন্তু কেমন করে জানলে জেমস! তুমি কি ভবিষ্যতের কথা জানতে পার?
টেলিগ্রামের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে জেমস স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন, ধীরকণ্ঠে বললেন, না, এমিলি, ভবিষ্যতের কথা আমি সবসময় জানতে পারি না। তবে জাহাজে ওঠার পূর্বমুহূর্তে হঠাৎ আমি অনুমান করেছিলাম ওই জাহাজে উঠলে তার পরিণাম আমাদের পক্ষে অশুভ হবে।
এমন অদ্ভুত অনুমানের কারণ? লিংকন খুব মজবুত জাহাজ। ঝড়ের আঘাতে ওই জাহাজ কখনো ডুবে যেতে পারে এমন কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না। এমন অভাবিত দুর্ঘটনার কথা তুমি শুধু অনুমান করেই সাবধান হয়েছিলে?
এমিলি! লিংকন জাহাজ জলমগ্ন হবে কি না সে-কথা আমার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব ছিল না। ওই সমুদ্রযাত্রা যে আমাদের পক্ষে মঙ্গলদায়ক হবে না আমি শুধু এই কথাটাই বুঝেছিলাম। যাক, এসব কথা বলতে আর ভাবতে ভালো লাগছে না। তোমার আপত্তি না-থাকলে বরং চলো–একটা নাট্যশালায় গিয়ে খানিকটা সময় কাটিয়ে আসি।
এমিলির আপত্তি ছিল না। প্যারিস শহরে একটা অপেরা-হাউস-এ তখন জনপ্রিয় প্রদর্শনী। চলছিল, স্বামী-স্ত্রী সেইখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। হোটেলের একটি ভৃত্যকে ডেকে গাড়ি আনতে নির্দেশ করলেন জেমস। একটু পরেই ভৃত্যটি এসে জানাল অশ্বচালিত একটি শকট তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে নির্দিষ্ট গাড়িটির সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন জেমস। এমিলি দেখলেন তার স্বামীর স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে অশ্বচালকের মুখের দিকে। এমিলি শুনতে পেলেন জেমস অস্ফুটস্বরে স্বগতোক্তি করছেন, সে কী! এত শীঘ্র!
গাড়ির চালক অসহিষ্ণুস্বরে বলল, সিয়ে, তাড়াতাড়ি উঠুন। শুনলাম আপনারা নাট্যশালায় যাবেন। অভিনয় শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই, চটপট উঠুন।
জেমস চালকের কথায় কর্ণপাত করলেন না, তিনি হাত নেড়ে বললেন, আমরা যাব না, তুমি অন্য যাত্রীর সন্ধানে যাও।
বিস্মিত চালক বলল, সে কী মঁসিয়ে! আপনার চাকর যে বললে–
বাধা দিয়ে জেমস বললেন, আমার চাকর নয়, হোটেলের চাকর। সে ভুল করেছে। যাই হোক তোমার সময় নষ্ট হয়েছে সেজন্য আমি দুঃখপ্রকাশ করছি এবং যতটা সম্ভব তোমার ক্ষতিপূরণ করে দিচ্ছি–
পকেট থেকে একটি মুদ্রা বার করে জেমস বিস্মিত চালকের হাতে দিয়ে তাকে চলে যেতে ইঙ্গিত করলেন। চালকের ক্ষোভের কারণ রইল না, সে ঘোড়া ছুটিয়ে অন্য যাত্রীর সন্ধানে যাত্রা করল।
এমিলি এতক্ষণ বোবা হয়ে ছিলেন। এইবার আর তিনি ক্রোধ প্রকাশ করলেন না, লিংকন জাহাজের ঘটনা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কি আজ নাটক দেখতে যাব না?
জেমস বললেন, নিশ্চয়ই যাব। একটু অপেক্ষা করো, আর একটা গাড়ি এখনই পাওয়া যাবে।
গাড়ি পাওয়া গেল, তবে এখনই নয়। প্রায় আধঘণ্টা পরে একটা ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া গিয়েছিল।
…অপেরা-হাউস-এর কাছাকাছি আসতেই স্বামী-স্ত্রীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল আকাশের দিকে। রাতের আকাশে অন্ধকার ভেদ করে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে রক্তিম আলোর বন্যা এবং দূর থেকে ভেসে আসছে বহু মানুষের কোলাহল ধ্বনি!
চালক বলল, আগুন!
বলার অবশ্য দরকার ছিল না। অন্ধকার রাত্রির কালো যবনিকা ভেদ করে আকাশের গায়ে রক্তরাঙা আলোকধারার এমন হঠাৎ আবির্ভাবের কারণ যে এক ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড ছাড়া আর, কিছু হতে পারে না, সে-কথা অনুমান করতে স্বামী-স্ত্রীর বিশেষ অসুবিধা হয়নি।
একটু এগিয়ে যেতেই জনতার চাপে গাড়ির গতি রুদ্ধ হয়ে গেল। স্বামী-স্ত্রীর বিস্মিত সৃষ্টির সম্মুখে ফুটে উঠল এক ভয়াবহ অগ্নিময় দৃশ্য!
এমিলি প্রায় অবরুদ্ধ স্বরে বললেন, জেমস! ওই নাট্যশালাতেই আমরা সময় কাটাতে এসেছিলাম!