তরবারি কোষমুক্ত করে সেই তরবারির অগ্রভাগ রবিনহুডের স্কন্ধে স্থাপন করে রিচার্ড বললেন, রবিনহুড! আজ থেকে তুমি আর শেরউড বনের পলাতক নও। তোমাকে আমি নটিহাম নগরীর শেরিফের পদে নিযুক্ত করলাম। তোমার সঙ্গীরা এখন থেকে তোমার দেহরক্ষী সেনাদলে পরিণত হল। সবাইকে জানিয়ে দাও, এখন থেকে শেরউড বন রাজা রিচার্ডের সম্পত্তি- এই বনে হরিণ মারলে হরিণ-শিকারির প্রাণদণ্ড হবে।
উঠে দাঁড়িয়ে বিহ্বল কণ্ঠে রবিনহুড বলল, রাজা রিচার্ড। যতদিন বাঁচব ততদিন আমি এবং আমার সঙ্গীরা আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে রাজসেবা করব।
তারপরই কোষমুক্ত তরবারি ঊর্ধ্বে তুলে রবিনহুড চিৎকার করে উঠল, জয়! রাজা রিচার্ডের জয়!
অ্যাংলো-স্যাক্সন দস্যুদল ও নর্ম্যান-সেনাবাহিনী রবিনহুডের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সমবেতভাবে গর্জন করে উঠল, জয়! রাজা রিচার্ডের জয়।
সংকেত
-না, আমরা যাব না, তুমি মালপত্রে হাত দিয়ো না।
–সে কী ঘঁসিয়ে! আপনি লাগেজ নিয়ে এসেছেন, একটু পরেই জাহাজ ছাড়বে! আপনি বলছেন কী?
–ঠিকই বলছি। আমি মত পরিবর্তন করেছি। আমার ইচ্ছে হয়েছিল এই জাহাজে যাব, এখন আমার ইচ্ছে নেই, তাই যাব না–বুঝেছ?
কুলিটি কিছুক্ষণ আশ্চর্য হয়ে মি. গিলবার্টের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর দ্রুতপদে আর একটি যাত্রীর কাছে এগিয়ে গিয়ে তার মালপত্র তুলে নিয়ে জাহাজের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।
মিসেস গিলবার্ট স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন স্তম্ভিতের মতো, নিজের শ্রবণশক্তিকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না–কী বলছেন তার স্বামী?
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস ত্যাগ করে আমেরিকায় গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সংকল্প করেছিলেন গিলবার্ট-দম্পতি আর এ নিয়ে বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের জল্পনাকল্পনারও অন্ত ছিল না। কিন্তু টিকিট বুক করে জাহাজে ওঠার কয়েক মুহূর্ত আগে হঠাৎ গিলবার্ট তার মত পরিবর্তন করলেন কেন?
যে কুলিটি তাদের মালপত্র বহন করার জন্য এগিয়ে এসেছিল তাকে উদ্দেশ্য করে মি. গিলবার্ট যা বললেন তার মর্মার্থ হচ্ছে : তারা যাত্রা স্থগিত রাখছেন; অতএব তাদের মালপত্র বহন করার জন্য কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।
কুলিকে বিদায় দিয়ে মি. গিলবার্ট এইবার তার মালপত্র গুছিয়ে প্যারিসেই ফিরে যাওয়ার উদযোগ করতে লাগলেন। মিসেস এমিলি গিলবার্ট এতক্ষণ একটিও কথা বলেননি, এইবার তিনি দারুণ ক্রোধে ফেটে পড়লেন, জেমস! তোমার এই মত পরিবর্তনের কারণ কী? আমাকে কি তুমি মানুষ বলে মনে কর না? জাহাজের টিকিট কেটে জেটিতে এসে যাত্রার পরমুহূর্তে তুমি যাত্রা স্থগিত করলে! অর্থাৎ আমাকে নিয়ে একটা নিষ্ঠুর কৌতুক করে তুমি বুঝিয়ে দিতে চাও যে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে আমাকে তোমার ঘর করতে হবে যেহেতু তুমি অগাধ অর্থের মালিক!
স্ত্রীর কঠিন তিরস্কারের উত্তরে গিলবার্ট কোনো কথা বললেন না, কেবল একটি কুলিকে ডেকে মালপত্র তুলে নিতে অনুরোধ করলেন, তারপর ধীরপদে এগিয়ে চললেন রাজপথের দিকে একটি ভাড়াটে গাড়ির উদ্দেশে।
চলন্ত গাড়ির ভিতর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন মিসেস এমিলি গিলবার্ট। তিনি যে অত্যন্ত আঘাত পেয়েছেন সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। মাত্র তিন মাস হল প্যারিসে তাদের বিবাহ হয়েছে; নববিবাহিতা তরুণী স্বামীর কাছে এমন বিসদৃশ ব্যবহার আশা করেননি। এতক্ষণ বন্দরের ভিতর আত্মসংবরণ করে থাকলেও গাড়ির ভিতর বসে মিসেস গিলবার্ট আর অবরুদ্ধ ক্রন্দনের বেগ সামলাতে পারলেন না। জেমসের নির্দেশ অনুসারে গাড়ি ছুটতে লাগল প্যারিস শহরের একটা হোটেলের দিকে। স্বামীর মুখোমুখি বসে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন তার স্ত্রী এবং নববধূর ক্রন্দনে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বসে রইলেন জেমস গিলবার্ট এক অনড় প্রস্তরমূর্তির মতো।
জাহাজ ধরতে যাওয়ার আগে যে হোটেলে গিলবার্ট-দম্পতি বাস করছিলেন, বন্দর থেকে ফিরে এসে তারা আবার সেই হোটেলেই উঠলেন। গাড়ির মধ্যে এমিলি স্বামীর সঙ্গে একটিও কথা বলেননি, হোটেলে এসেও তাঁর মৌনব্রত ভঙ্গ হল না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরাজ করতে লাগল অসহ্য নীরবতার এক অদৃশ্য প্রাচীর।
কয়েকদিন পরের কথা। কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস ক্রয় করার জন্য মার্কেটিং-এ বেরিয়েছিলেন। এমিলি, বিষাদের ছায়া তখনো মিলিয়ে যায়নি তাঁর মন থেকে। নববধূর আশাভঙ্গের বেদনাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের যে পূর্ব-ইতিহাস জানতে হবে তা হচ্ছে এই
প্যারিসের বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েকটি ঐতিহাসিক তথ্য ও নিদর্শন সংগ্রহ করতে এসেছিলেন আমেরিকার প্রত্নতাত্ত্বিক জেমস গিলবার্ট। ওইখানে অর্থাৎ প্যারিস নগরীতেই এমিলির সঙ্গে জেমসের পরিচয় হয় এবং কিছুদিন পরে তারা পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন। এমিলির মাতৃভূমিও আমেরিকা, কিন্তু ঘটনাচক্রে তিনি ফ্রান্সে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিবাহের পর নববিবাহিতা তরুণী স্বামীর সঙ্গে মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন এবং সত্যি সত্যিই তাঁদের আমেরিকা যাত্রার দিন যখন স্থির হয়ে গেল তখন যে এমিলি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন সে-কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু জাহাজে ওঠার পূর্বমুহূর্তে জেমস যে ভাবে বিনা কারণে যাত্রা স্থগিত করলেন তাতে মনে হয় স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য তাঁর কাছে নেই–নিজের খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য স্ত্রীকে আঘাত করতে বা অপমান করতে তার বিবেকে বাধে না।