নৰ্মান-সৈন্যদল বিস্ময়ে নির্বাক। স্যার স্টিফেনের পরাজয় তাদের কল্পনাতীত।
শূন্যে বদ্ধমুষ্ঠি আন্দোলন করে ব্ল্যাক নাইট আবার বললেন, তোমরা এসে আমার কথা সত্য কি না পরীক্ষা করে দেখতে পার। আমি বলছি, স্যার স্টিফেনের দেহে প্রাণ নেই।
নর্ম্যানদের মধ্যে কেউ এগিয়ে এসে স্যার স্টিফেনের দেহ পরীক্ষা করার আগ্রহ প্রকাশ করল না। ভূপতিত দেহের অনড় অবস্থা এবং কণ্ঠনিঃসৃত রক্তধারা দেখেই বুঝতে পেরেছিল ব্ল্যাক নাইটের কথা মিথ্যা নয়- স্যার স্টিফেনের আত্মা শূলের আঘাতে দেহ ছেড়ে পরলোকের দিকে যাত্রা করেছে, পড়ে আছে শুধু মৃতদেহ।
স্যার জিওফ্রে ম্যালপাৰ্ট নামে যে নর্মান নাইট দ্বৈরথ যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছিল, স্যার স্টিফেনের অবর্তমানে সেই হল নৰ্মান বাহিনীর অধিনায়ক। প্রথা-অনুসারে সে এইবার অস্ত্র সমর্পণ করতে এগিয়ে এল ব্ল্যাক নাইটের দিকে।
ম্যালপার্টের যুদ্ধাস্ত্র ছিল তদানীন্তকালে বিখ্যাত প্রকাণ্ড এক রণকুঠার। উক্ত কুঠার ছিল অতিশয় গুরুভার। ম্যালপার্ট অস্ত্রটিকে মাথার উপর তুলে ধরতে পারত না। কিন্তু এমন ভারী আর ধারাল ছিল সেই অস্ত্রটি, যে, কিছুটা তুলে আঘাত করতে পারলেই কার্যসিদ্ধ হত।
ম্যালপার্ট এগিয়ে এসে কুঠারটি সমর্পণের ভঙ্গিতে এগিয়ে দিল ব্ল্যাক নাইটের দিকে, তারপর কম্পিত স্বরে বলল, হে বিজয়ী বীর! এই কুঠার গ্রহণ করুণ এবং প্রথা অনুসারে জনসমক্ষে আপনার নাম, ধাম ও সম্পূর্ণ পরিচয় ঘোষণা করুন।
বাঁ হাতে কুঠারটি ছিনিয়ে নিয়েই ব্ল্যাক নাইট অস্ত্রটিকে অবহেলাভরে দূরে নিক্ষেপ করলেন। সমবেত জনতা বিস্মিত নেত্রে দেখল সেই গুরুভার কুঠার শূন্যপথে আট-দশ হাত অতিক্রম করে মাটির উপর সশব্দে আছড়ে পড়ল। এই অমানুষিক শক্তির পরিচয় পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল অ্যাংলো-স্যাক্সন দস্যুদল আর নর্মান সেনাবাহিনী।
ব্লাক নাইট বললেন, হ্যাঁ, অস্ত্র সমর্পণ করার সময়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রথা অনুসারে আমার পরিচয় জানার জন্য তোমরা আগ্রহ প্রকাশ করতে পার– সে অধিকার তোমাদের আছে।
একটু থেমে ব্ল্যাক নাইট আবার বললেন, বন্ধুবর রবিনহুড এবং তার সহচরবর্গও আমার পরিচয় জানতে উদগ্রীব। আমি বলেছিলাম সময় হলেই স্বনামে আত্মপ্রকাশ করব। এবার সময় হয়েছে।
এক টান মেরে শিরস্ত্রাণ ও মুখের আবরণ খুলে ফেলে ব্ল্যাক নাইট বললেন, ম্যালপার্ট! চেয়ে দেখ– বোধ হয় আমি তোমার অপরিচিত নই।
ব্ল্যাক নাইটের আবরণমুক্ত মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই ম্যালপার্টের কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল অস্ফুট আর্তনাদ।
পরক্ষণেই ভূমিতলে জানু পেতে বসে সে বলে উঠল, রাজা রিচার্ড! আপনি আমার অভিবাদন গ্রহণ করুণ।
গর্বোন্নত মস্তক তুলে ব্ল্যাক নাইট বজ্রগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করলেন, নান সৈন্যগণ। তোমরা শ্রবণ করো আমার নাম রিচার্ড প্ল্যান্টাজেনেট। ইংল্যান্ডের সিংহাসনের আমিই প্রকৃত অধিকারী। আমি যে প্যালেস্টাইন থেকে বহু বিপদ-আপদ অতিক্রম করে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছি, সেকথা এখনও জনসাধারণের অজ্ঞাত। কিন্তু আমার ভাই জন এবং রাজদরবারের কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আমার গতিবিধি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, সেকথাও আমি জানি। যদি সহজে জন আমাকে ইংল্যান্ডের সিংহাসন ছেড়ে দিতে রাজি না হয়, তাহলে আমি যুদ্ধ করব। সৈন্যগণ! তোমাদের মধ্যে অনেকেই এক সময়ে আমার অধীনে যুদ্ধ করেছ। তবু তোমরা যদি আমাকে সমর্থন করে আমার অনুগামী হতে অনিচ্ছুক হও, তাহলে স্বচ্ছন্দে এই স্থান ত্যাগ করে যথা ইচ্ছা গমন করতে পার; কেউ তোমাদের বাধা দেবে না।
সৈন্যদের মধ্যে জাগল অস্ফুট কোলাহল, ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল সেই শব্দের তরঙ্গ, অবশেষে সমুদ্র-গর্জনের মতো প্রচণ্ড শব্দে ফেটে পড়ল নর্ম্যান-সেনার উল্লাস, জয়! রাজা রিচার্ডের জয়!
শূন্যে হাত তুলে রিচার্ড সেনাদের স্তব্ধ হতে ইঙ্গিত করলেন। জয়োল্লাস থামতেই রিচার্ড আবার উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করলেন, সৈন্যগণ! তোমাদের মধ্যে যারা আমাকে অনুসরণ করতে অনিচ্ছুক, তারা নির্ভয়ে স্থান ত্যাগ করতে পার। কেউ তোমাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করবে না।
একটি প্রাণীও স্থানত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করল না। শত শত কণ্ঠে আবার জাগল জয়ধ্বনি, জয়! রাজা রিচার্ডের জয়!
একটু দূরেই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল রবিনহুড। সেইদিকে একবার দৃষ্টিপাত করে রিচার্ড বললেন, মাস্টার রবিন! এদিকে এস।
রাজার সামনে এসে নতজানু হয়েই অভিবাদন জানাল রবিনহুড। তাকে উদ্দেশ্য করে রিচার্ড বললেন, রবিনহুড! দেশে এসে তোমার সম্পর্কে সত্য মিথ্যা নানারকম কথা শুনে তোমাকে দেখার আগ্রহ হয়েছিল। তাই ব্লাক নাইটের ছদ্মবেশ ধারণ করে শেরউড বনে প্রবেশ করেছিলাম। যা দেখলাম, যা জানলাম, তাতে বুঝতে পারছি।
বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে মর্মভেদী দৃষ্টিতে রবিনহুডের দিকে তাকালেন রিচার্ড। ভূমিতলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে রবিনহুড স্থির হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল রাজার অভিমত শোনার জন্য তার সহচর দস্যুদলের চোখে-মুখে ফুটল শঙ্কার আভাস।
বুঝলাম, রিচার্ড তার অসমাপ্ত বাক্য সমাপ্ত করলেন, আমার পক্ষে তোমার মতো একটি মানুষের সাহায্য নিতান্তই প্রয়োজন।