তুমি দেখছি একজন নর্ম্যান নাইট, স্যার স্টিফেন বিস্মিত স্বরে বলল, নর্মান যোদ্ধা হয়ে একদল দস্যর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে লজ্জা হল না? ওরা তো ফাঁসির দডির জন্য অপেক্ষা করছে।
ওরা দীর্ঘকাল ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করতে পারে, ব্ল্যাক নাইট বললেন, তাতে তোমার বা আমার কিছু আসে যায় না।
তুমি কি বলতে চাও?
–তোমাদের খাদ্য ফুরিয়ে এসেছে। কত দিন আর এভাবে চলবে?
যত দিন চলে। বাইরে থেকে যে-কোনো সময়ে সাহায্য এসে পড়তে পারে।
তত দিনে তোমাদের অনাহারে মৃত্যু ঘটবে। তার চাইতে বরং আত্মসমর্পণ করো।
–কখনই নয়। অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি; কিন্তু দস্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করব না।
এই সমস্যা সমাধানের একটি মাত্র সম্মানজনক উপায় আছে।
–উপায়টা কি?
—দ্বন্দ্বযুদ্ধ।
স্যার স্টিফেন চিৎকার করে উঠল, তুমি আমকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছ?
–হাঁ, এই তার নিশানা।
ব্ল্যাক নাইট তাঁর ডান হাতের লৌহ-দস্তানা খুলে মাটির উপর ছুঁড়ে ফেললেন। তখনকার দিনে ওইভাবে যোদ্ধারা প্রতিপক্ষকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানাতেন।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল স্যার স্টিফেন, তারপর বলল, আমি যদি যুদ্ধে জয়লাভ করি, তাহলে সৈন্যদের নিয়ে নিরাপদে স্বস্থানে ফিরে যেতে পারব?
–নিশ্চয়।
–দস্যুকে বিশ্বাস কি?
রবিনহুড এগিয়ে এসে চিৎকার করে বলল, আমরা দস্যু হতে পারি, কিন্তু কখনো প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করি না। স্যার স্টিফেন! রবিনহুড কথা দিয়ে কথা রাখেনি, এমন একটি দৃষ্টান্ত কি তুমি দেখাতে পার?কয়েকটি নীরব মুহূর্ত। তারপর স্তব্ধতা ভেদ করে জাগল স্যার স্টিফেনের কঠোর কণ্ঠস্বর, আমি আহ্বান গ্রহণ করলাম। ব্ল্যাক নাইট! ঈশ্বরের কাছে শেষ প্রার্থনা জানাও। আমি আসছি। আজ তোমার শেষ দিন।
দুর্গচুড়া থেকে অন্তর্ধান করল স্যার স্টিফেন। ব্ল্যাক নাইটের ইঙ্গিতে রবিনহুডের এক অনুচর ভীষণদর্শন এক শূল ও ঢাল এনে তুলে দিল ব্ল্যাক নাইটের হাতে।
কিছুক্ষণ পরেই সশব্দে খুলে গেল দুর্গের সিংহদ্বার এবং অশ্বপৃষ্ঠে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করল আপাদমস্তক লৌহবর্মে আবৃত জনৈক যোদ্ধা- স্যার স্টিফেন।
রোমাঞ্চকর এক রক্তাক্ত দৃশ্যের প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল রবিনহুড ও তার সঙ্গীদল। এটা অ্যাংলো-স্যাক্সনদের খেটে বা লাঠির লড়াই নয়এই লড়াই শূল ও তরবারি নিয়ে বর্মাবৃত নৰ্মান নাইটদের মৃত্যুপণ যুদ্ধ।
দুর্গ-প্রাকার ও ছাদের উপর ভিড় করে দাঁড়াল নর্ম্যান-সেনাদল। তাদের আগ্রহও কম নয়। যদিও তাদের অধিনায়কের জয়লাভ সম্পর্কে তারা ছিল নিশ্চিত, তবুও স্যার স্টিফেনের মতো দুর্জয় যোদ্ধাকে যে-নাইট দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাতে সাহসী হয়, তার রণকৌশল দেখার জন্য নৰ্মানরা ছিল অতিশয় উগ্রীব। প্রতিদ্বন্দ্বীরা দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে প্রচলিত প্রথা অনুসারে একজন মধ্যস্থ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর পরিচয় ঘোষণা করে, তারপর তুর্যধ্বনি করে যুদ্ধ আরম্ভের সংকেত দেওয়া হয়।
এখানে সে-সব কিছুই হল না। স্যার জিওফ্রে ম্যালপার্ট নামে একজন নর্মান নাইট তার হাতের রক্তবর্ণ রুমাল মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে যুদ্ধের নির্দেশ দিল– সঙ্গেসঙ্গে দুই দিক থেকে উদ্যত শূল হাতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ঘোড়া ছুটিয়ে দিল পরস্পরের দিকে।
দুর্গের সামনে উচ্চভূমির উপর একটা সমতলভূমি ছিল যোদ্ধাদের লক্ষ্যস্থল। ওই জায়গাটার উপর যুদ্ধ হলে কোনো পক্ষই বিশেষ কোনো সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে না- যার রণকৌশল ও শারীরিক শক্তি বেশি, সে-ই হবে জয়ী। কিন্তু যে-যোদ্ধা প্রতিদ্বন্দ্বীর আগে সমতলভূমি অতিক্রম করে অপর পক্ষকে অক্রমণ করতে পারবে, তারই জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি। কারণ, তলা থেকে যে ব্যক্তি উপর দিকে অশ্বারোহণে উঠেছে, তার পক্ষে উপর থেকে নেমে আসা ধাবমান অশ্বের পৃষ্ঠে উপবিষ্ট যোদ্ধার শূলের আঘাত সহ্য করা প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। ব্ল্যাক নাইট ও তার ঘোড়ার চাইতে বাহনসমেত স্যার স্টিফেনের ওজন অনেক কম, তাই স্যার স্টিফেনের ঘোড়া প্রতিপক্ষের তুলনায় অধিকতর ক্ষিপ্র এবং দ্রুতগামী অতএব, দেখা গেল স্যার স্টিফেনের ঘোড়া যখন সমভূমি পার হয়ে নীচের দিকে নামছে, ব্ল্যাক নাইটের কালো ঘোড়া তখন ঢালু জমি বেয়ে উপর দিকে মাত্র অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছে।
প্রতিদ্বন্দ্বীকে লক্ষ্য করে ঝড়ের বেগে নামতে লাগল স্যার স্টিফেনের সুশিক্ষিতি অশ্ব। তৎক্ষণাৎ দুর্গপ্রাচীর ও চুড়ার উপর জগল নৰ্মান বাহিনীর কণ্ঠে তুমুল উল্লাসধ্বনি।
শরীরী ঝটিকার মতো স্যার স্টিফেনের ঘোড়া এসে পড়ল ব্ল্যাক নাইটের সম্মুখে, পরক্ষণেই দুটি প্রকাণ্ড শূল সবেগে পরস্পরকে আঘাত করল।
ব্ল্যাক নাইটের ঢালের উপর প্রচণ্ড সংঘাত-ধ্বনি তুলে ভেঙে গেল প্রতিদ্বন্দীর শুল। সেই দারুণ আঘাতেও কিছুমাত্র বিচলতি হলেন না ব্ল্যাক নাইট, অশ্বপৃষ্ঠে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে রইল তাঁর বিশাল দেহ।
কিন্তু তাঁর হাতের অস্ত্র ব্যর্থ হল না প্রতিদ্বন্দ্বীর ঢাল এড়িয়ে শূল অঘাত হানল। লৌহবর্ম ভেদ করে শূল বিদ্ধ হল স্যার স্টিফেনের কণ্ঠদেশে। পরক্ষণেই ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ল স্যার স্টিফেন। অশ্বপৃষ্ঠ থেকে এক লাফে নেমে এসে শত্রুর কাছে গিয়ে তার শিরস্ত্রাণ ও মুখের আবরণ খুলে ফেললেন ব্ল্যাক নাইট, কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ভূপতিত শত্রুর দিকে, তারপর ভীষণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, নৰ্মান সৈন্যগণ! তোমাদের অধিনায়ক মৃত। দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রথা অনুসারে তোমাদের বর্তমান সেনানায়ক এগিয়ে এসে আমার হাতে তার অস্ত্র সমর্পণ করুক।