আবার! আবার সেই চিৎকার!
অন্ধকার রাত্রির নীরবতা ভঙ্গ করে অ্যালেনের পিছন থেকে ভেসে এল সেই উৎকট শব্দের তরঙ্গ!
দারুণ আতঙ্কে অ্যালেনের ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে উঠল।
নিশ্চিত মৃত্যুর বার্তা বহন করে তার দিকে এগিয়ে আসছে হিংস্র শ্বাপদ!
দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অ্যালেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। অন্ধকারের মধ্যে সংকীর্ণ গিরিপথটা আর এখন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, তবু সে একবারও পথের দিকে দৃকপাত করলে না।
আতঙ্কে আত্মহারা হয়ে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল।
আচম্বিতে তার পায়ের তলা থেকে সরে গেল মৃত্তিকার নিরেট স্পর্শ, পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে খসে পড়ল বন্দুকটা তার হাত থেকে।
অ্যালেন অনুভব করলে তার দেহটা শূন্যপথে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে!
অন্ধের মতো দু-হাত বাড়িয়ে দিতেই তার হাতে কয়েকটা গাছের শিকড় লাগল। শক্ত মুঠিতে শিকড়গুলো চেপে ধরে পতনোন্মুখ দেহটাকে সে কোনোরকমে রক্ষা করলে।
তার পায়ের ধাক্কা লেগে কয়েকটা পাথর পাহাড়ের গা বেয়ে নীচের দিকে গড়িয়ে পড়ল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না–তবু বহুদূরে নীচের দিক থেকে স্থলিত প্রস্তরের যে পতন-শব্দ ভেসে এল সেই আওয়াজ থেকেই অ্যালেন বুঝল তার পায়ের তলায় হাঁ করে আছে গভীর খাদ। এখান থেকে পড়ে গেলে বাঁচবার আশা নেই।
অতিকষ্টে একটু একটু করে সে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগল। একটু পরে একটা সংকীর্ণ জায়গায় সে পা রাখার মতো অবলম্বন খুঁজে পেল।
হঠাৎ অ্যালেনের সর্বাঙ্গে জাগল অস্বস্তিকর অনুভূতির তীব্র শিহরন। ঘন অন্ধকার ভেদ করে কোনো কিছু দৃষ্টিগোচর হওয়ার উপায় নেই কিন্তু সে অনুভব করলে শয়তান বুড়ো তার খুব কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে।
মাথার উপর হিংস্র শ্বাপদ, পায়ের তলায় অতলস্পর্শী খাদ–ভয়াবহ অবস্থা!
অকস্মাৎ দারুণ আক্রোশে পরিপূর্ণ হয়ে গেল অ্যালেনের সমগ্র চেতনা। ভয়ের পরিবর্তে জেগে উঠল ক্রোধ। বিদ্যুৎচমকের মতো তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।
বন্দুকটা তার হাত থেকে খসে পড়েছিল বটে কিন্তু অস্ত্রটা তখনও হাতছাড়া হয়নি। চামড়ার ফিতা দিয়ে বন্দুকটা আটকানো ছিল তার কাঁধের সঙ্গে, হাত থেকে খসে পড়লেও অ্যালেনের দেহলগ্ন চর্মরঙ্কুর বন্ধনে ঝুলছিল বন্দুক।
সে এইবার অস্ত্রটাকে বাগিয়ে ধরে কোট এবং টুপি খুলে ফেলল।
বন্দুকের নলের মুখে সে এমনভাবে কোট আর টুপি বসিয়ে দিল যে উপর থেকে দেখলে নির্ঘাত মনে হবে একটা মানুষ টুপি মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।
তারপর টুপি-কোট জড়ানো বন্দুকটাকে সে তুলে ধরলে খাদের মুখে।
আচম্বিতে তার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল–অন্ধকারের কালো যবনিকা ভেদ করে জ্বলছে একজোড়া প্রদীপ্ত শ্বাপদ চক্ষু!
পরক্ষণেই অন্ধকারের চেয়েও কালো এক অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল টুপি-কোট–জড়ানো বন্দুকের উপর! সেই দারুণ সংঘাতে। বন্দুকসমেত অ্যালেনের দেহটা আর একটু হলেই ছিটকে পড়ত। খাদের ভিতর কোনোরকমে টাল সামলে নিয়ে সে দেখল গিরিপথের উপর থেকে ঠিকরে এসে তার পাশেই সংকীর্ণ জায়গাটার উপর ভারসাম্য রেখে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। একটা চতুষ্পদ জীব! পুমা!
–দারুণ আতঙ্কে অ্যালেনের কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল এক ভয়াবহ চিৎকার, দু-হাতে বন্দুকটা তুলে ধরে সে আঘাত হানতে উদ্যত হল।
কিন্তু প্রয়োজন ছিল না; পুমার নখগুলো পাথরের ওপর ফসকে গেল, জন্তুটা গড়িয়ে পড়তে লাগল নীচের দিকে!
অ্যালেন দেখল পুমা বার বার নখ দিয়ে পাহাড়ের ঢালু জমি আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে। চেষ্টা সফল হল না।
মহাশূন্যে ছিটকে পড়ে অনেক নীচে অন্ধকারের গর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই অতিকায় মার্জারের দেহ।
সকাল হল। নীচের দিকে তাকিয়ে ধরাশায়ী জন্তুটাকে দেখতে পেল অ্যালেন।
হ্যাঁ, বুড়োই বটে! জন্তুটা মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে কিন্তু তখনও মরেনি! তার কপিশ-পিঙ্গল চক্ষু দুটি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অ্যালেনের দিকে!
অ্যালেন সবিস্ময়ে দেখল শ্বাপদের দৃষ্টিতে মৃত্যু-যাতনার চিহ্ন নেই–হিংস্র আক্রোশে দপদপ করে জ্বলছে পুমার দুই প্রদীপ্ত চক্ষু!
অ্যালেন চোখ ফিরিয়ে নিলে অন্যদিকে।
অকস্মাৎ ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো অকুস্থলে উপস্থিত হল অ্যালেনের মনিব ম্যাকগিল এবং দুজন রাখাল। ঘটনাস্থলে তাদের উপস্থিতি খুবই আকস্মিক বটে কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। যে ঘটনার সূত্র ধরে তাদের আবির্ভাব ঘটেছিল তা হচ্ছে এই :
অ্যালেনের ঘোড়া গতরাত্রেই তার আস্তানায় ফিরে গিয়েছিল। আরোহীবিহীন অশ্বের শূন্য পৃষ্ঠদেশ দেখে ম্যাকগিল উদবিগ্ন হয়ে ওঠে কিন্তু রাতের অন্ধকারে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব নয় বলেই সে অপেক্ষা করতে থাকে প্রভাতের জন্য।
ভোরের আলো ফুটতেই দুজন রাখালকে নিয়ে ম্যাকগিল খোঁজাখুঁজি শুরু করল এবং তার অভিজ্ঞ চক্ষু কিছুক্ষণের মধ্যেই খুঁজে পেল অ্যালেনের জুতোর দাগ। ওই দাগ ধরে একটু যেতেই তাদের চোখে পড়ল পুমার পায়ের ছাপ। শ্বাপদের পদচিহ্ন বিশ্লেষণ করে তারা যখন বুঝল পদচিহ্নের মালিক হচ্ছে বুড়ো এবং সংকীর্ণ গিরিপথে তার লক্ষিত শিকার হচ্ছে অ্যালেন, তখনই তারা অ্যালনকে জীবন্ত অবস্থায় ফিরে পাওয়ার আশা ত্যাগ করেছিল। অক্ষত অবস্থায় নিখোঁজ মানুষটিকে দেখে তারা যেমন খুশি হয়েছিল তেমনই আশ্চর্য হয়েছিল।