কিন্তু ফ্ল্যাটহেড অঞ্চলে এমন একটি ঘটনা ঘটল যে স্থানীয় বাসিন্দারা সকলেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হল এই সৃষ্টিছাড়া পুমাটা সুযোগ পেলে মানুষকে হত্যা করে নরমাংস ভক্ষণ করতেও দ্বিধা বোধ করবে না।
ঘটনাটা বলছি—
হারানো গোরুর খোঁজে টহল দিতে দিতে জর্জ টেলর নামে একটি রাখাল হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। প্রতিবেশীরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে সাতদিন বাদে তার মৃতদেহটাকে আবিষ্কার করলে একটা গাছের নীচে। ছিন্নভিন্ন মৃতদেহটার ওপর নজর বুলিয়ে সকলেই বুঝল কোনো মাংসাশী পশু জর্জের দেহটাকে মনের আনন্দে চর্বণ করেছে। আশেপাশে জমির উপর রয়েছে পুমার পায়ের ছাপ।
স্থানীয় অধিবাসীরা বললে জর্জের হত্যাকারী হচ্ছে বুড়ো। অধভুক্ত দেহটা দেখে তারা স্পষ্ট বুঝল বুড়ো একটি ভয়ংকর নরখাদক পুমা।
তারপর থেকে মাঝে মাঝে দু-একটি পথিকের নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ আসতে লাগল। সংবাদগুলো হয়তো সম্পূর্ণ সত্য নয়, হয়তো সেগুলো গুজব মাত্র কিন্তু স্থানীয় মানুষগুলির মধ্যে দারুণ আতঙ্কের সৃষ্টি হল।
ইতিমধ্যে ওই এলাকায় আবির্ভূত হল একটি নতুন মানুষ। আগন্তুকের নাম অ্যালেন বর্ডার। সে বুড়োর কথা শুনল বটে কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দিলে না। মানুষ মেরে মাংস খায় এমন পুমার গল্প তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়–নরখাদক পুমার অস্তিত্বে সে বিশ্বাস করে না।
পরবর্তী জীবনে তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে অ্যালেন জেনেছিল নখদন্তে সজ্জিত মাংসাশী শ্বাপদের খাদ্যতালিকার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই–বন্যপশুর স্বভাবচরিত্র বিশ্লেষণ করতে যদি ভুল হয় তবে ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে সেই ভুলের পরিণাম মারাত্মক হতে পারে।
বার-এক্স নামক একটি র্যানব বা গোশালায় চাকরি করতে এসেছিল অ্যালেন বর্ডার। বিভিন্ন কাজের মধ্যে হারানো গোরু বাছুরের সন্ধান নেওয়া ছিল তার অন্যতম কর্তব্য।
সেদিন দুপুরবেলা সে এবং গোশালার মালিক ম্যাকবিল ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়েছিল কয়েকটা নিখোঁজ গোরুর সন্ধানে করার জন্য। অনেকক্ষণ ধরে একটা উপত্যকার উপর তারা নিরুদ্দিষ্ট তিনটি গোরুকে দেখতে পেল। ঘোড়ার লাগামে টান মেরে দুজনেই থমকে দাঁড়াল।
গোরু তিনটির কাছে যেতে হলে প্রায় আধমাইল লম্বা দুর্গম পাহাড়ী পথ বেয়ে যাত্রা করতে হবে। রাতের অন্ধকারে নিজের এলাকার মধ্যে গেলে তিনটি গোরুকেই হত্যা করবে বুড়ো শয়তান; অতএব সকালের জন্যে অপেক্ষা করলে চলবে না।
গোরুগুলোকে বাঁচাতে হলে এখনই তাদের উদ্ধার করা দরকার।
ম্যাকগিলকে ঘরে ফিরে যেতে বলে অ্যালেন পাহাড়ি পথের ওপর দিয়ে গোরুগুলোর দিকে অশ্বকে চালনা করলে।
আকাশে দুলে উঠল সন্ধ্যার ধূসর অঞ্চল, পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় গ্রহণ করছে দিনান্তের শেষ আলোকধারা…
আচম্বিতে হল এক বিপদের সূত্রপাত।
অ্যালেনের বন্দুকটা ঘোড়ার পিঠে বাঁধা ছিল–হঠাৎ বন্ধনরঙ্কু আলগা হয়ে সেটা পড়ে গেল মাটির উপর। সঙ্গেসঙ্গে ভরা বন্দুকের গুলি ছুটে গেল; ঘোড়ার পায়ের তলায় বন্দুকের নল থেকে সগর্জনে নির্গত হলে চকিত অগ্নিশিখা!
ঘোড়া চমকে উঠে লাফ মারল এবং টাল সামলাতে না-পেরে ঘোড়ার পিঠ থেকে অ্যালেন সশব্দে অবতীর্ণ হল কঠিন মৃত্তিকার বুকে! ধরাশয্যায় শুয়ে শুয়েই সে শুনতে পেল পাথুরে জমির উপর বেজে উঠেছে ধাবমান অশ্বের পদশব্দ–ঘোড়া পালিয়ে যাচ্ছে।
অ্যালেন উঠে বসল। তার দেহে কোথাও আঘাত লাগেনি। শরীরের কয়েক জায়গা কেটে অল্পবিস্তর রক্তপাত হয়েছে বটে কিন্তু আঘাতগুলো মোটেই মারাত্মক নয়। বন্দুকটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে অ্যালেন পাহাড়ি পথ বেয়ে হাঁটতে লাগল। এই অঞ্চলের পথঘাট তার পরিচিত রাস্তাটা যে ভালোভাবেই চিনতে পেরেছিল।
কয়েক মাইল পথ ভেঙে পাহাড়ের নীচে নামতে পারলেই যে ঢালু জমিটার উপর পৌঁছে যাবে, সেখান থেকে গোশালায় ফিরে যেতে তার অসুবিধা হবে না। গোরুগুলোকে অবশ্য উদ্ধার করা যাবে না; কারণ ততক্ষণে অন্ধকার রাত্রির গর্ভে হারিয়ে যাবে দিবসের শেষ আলোকরশ্মি। ইতিমধ্যেই উপত্যকা আর খাদগুলোর উপর উড়েছে সুদীর্ঘ ছায়ার আবরণ–অন্ধকার হতে আর দেরি নেই।
বন্দুকটা হাতে নিয়ে অ্যালেন পাহাড়ি পথ বেয়ে পদচালনা করলে..
কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যালেনের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে দিলে ঘন অন্ধকার। তারার আলোতে অস্পষ্টভাবে পথ দেখতে দেখতে সে পা ফেলতে লাগল অতি সন্তর্পণে…
হঠাৎ চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অ্যালেন।
তার পিছন থেকে ভেসে এল একটা তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার! নারীকণ্ঠের আর্তস্বর!
এক মুহূর্তের জন্য ভুল করেছিল অ্যালেন। না, কোনো রমণীর কণ্ঠস্বর নয়–ওই ভীষণ চিৎকার ভেসে এসেছে পুমার গলা থেকে। নারীকণ্ঠের সঙ্গে পুমার কণ্ঠস্বরের কিছুটা মিল আছে। বটে কিন্তু এমন ভয়াবহ জান্তব ধ্বনি ইতিপূর্বে অ্যালেনের কর্ণগোচর হয়নি।
অ্যালেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।
নির্ভরযোগ্য কোনো অস্ত্র তার হাতে নেই, যে মস্ত ছোরাটা সে সর্বদাই সঙ্গে রাখে সেটাও আজ সে ফেলে এসেছে তার টেবিলের উপর। হাতের বন্দুকে ছিল একটিমাত্র গুলি, একটু আগের দুর্ঘটনায় সেই গুলিটাও ছুটে গেছে। তবু খালি বন্দুকটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরলে অ্যালেন, টোটা না-থাকলেও বন্দুকটাকে মুগুরের মতো ব্যবহার করা যাবে।