কুকুরটা তখন তার সঙ্গী যেদিকে গেছে তার বিপরীত দিকে ছুটছে।
দুই নম্বর কুকুরটাকে লক্ষ করে ডাউনির রাইফেল অগ্নিবৃষ্টি করল, কিন্তু অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এঁকেবেঁকে ছুটে জন্তুটা বুলেটের দংশন থেকে আত্মরক্ষা করতে লাগল।
ওয়ারুনার মালিক কিন্তু অন্য উপায় অবলম্বন করেছিলেন। গাড়িটাকে তিনি ধাবমান জন্তুটার গায়ের উপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পর তার চেষ্টা সফল হল–গাড়ির দুটো চাকাই সশব্দে ডিংগোটার দেহের উপর দিয়ে গড়িয়ে গেল। আহত জন্তুটা এইবার হিংস্র আক্রোশে গাড়ির আরোহীদের আক্রমণ করতে উদ্যত হল।
অব্যর্থ নিশানায় গুলি চালিয়ে মি. ডাউনি জন্তুটাকে ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে দিলেন।
কাছে গিয়ে দেখা গেল সদ্যমৃত ডিংগোটা স্ত্রীজাতীয় পশু। এইমাত্র যে তিন-পা-ওয়ালা কুকুরটা শিকারিদের ফাঁকি দিয়েছে মৃত ডিংগোটা যে সেই শয়তান রেড কিলার-এর সঙ্গিনী এ-বিষয়ে কারো সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র।
পরবর্তী ঘটনা থেকে জানা যায় সেইদিনই আর একবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল রেড কিলার, কিন্তু প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও সে বিপদকে ফাঁকি দিয়ে পলায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ যে, খুনি জানোয়ারটা যখন মি. ডাউনির গুলি খেয়ে আহত অবস্থায় একটা ঝোপের মধ্যে শুয়ে বিশ্রাম করছিল, সেই সময় হঠাৎ সে একটি কৃষকের নজরে পড়ে যায়। এক-ঘোড়ায়-টানা একটি গাড়ি চালিয়ে চলেছিল পূর্বোক্ত কৃষক এবং ধাবমান গাড়িটিকে অনুসরণ করে ছুটছিল কৃষকের পোষা কুকুর।
ঝোপের ভিতর শায়িত ডিংগোটাকে দেখেই কৃষক গাড়ি থামিয়ে দিল।রেড কিলার অবশ্য তৎক্ষণাৎ সরে পড়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কৃষক তাকে এত সহজে ছাড়ল না–পোষা কুকুরটাকে সে লেলিয়ে দিল তিন-পা-ওয়ালা ডিংগোটার দিকে।
কৃষকের পোষা কুকুরটা ছিল শক্তিশালী ক্যাঙারু হাউন্ড, বনচারী ডিংগোর যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রভুর নির্দেশে কুকুরটা ডিংগোকে আক্রমণ করল…
লড়াই চলল কিছুক্ষণ ধরে, তারপর অরণ্যের বন্য বিক্রমের কাছে পরাজয় স্বীকার করল মানুষের গৃহপালিত জীব–কণ্ঠদেশের ওপর সুগভীর দণ্ডাঘাতের চিহ্ন নিয়ে পিছিয়ে এল কৃষকের কুকুর। কৃষক এইবার গাড়িতে-জোতা ঘোড়াটাকে খুলে নিয়ে তার পিঠে উঠে বসল এবং ঘোড়া ছুটিয়ে তেড়ে গেল ডিংগোটার দিকে। কিন্তু ঘন সন্নিবিষ্ট গাছের সারির ভিতর দিয়ে ডিংগোটা কৃষকের ঘোড়াকে ফাঁকি দিয়ে পলায়ন করল…
বেশ কয়েকমাস কাটল নির্বিঘ্নে।
সকলেই নিশ্চিন্ত হল এই ভেবে যে অস্ট্রেলিয়ার লাল আতঙ্ক নিশ্চয়ই পটল তুলেছে।
কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীদের এই আনন্দ স্থায়ী হল না, আচম্বিতে এক শরীরী দুঃস্বপ্নের মতো আত্মপ্রকাশ করল রেড কিলার–কয়েকদিনের মধ্যেই খুনি ডিংগোটার কবলে প্রাণ হারাল অনেকগুলো মেষ।
শিকারিরা দলে দলে এসে ভিড় করল, কিন্তু তাদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ভেড়ার দলের উপর হামলা চালাতে লাগল তিন-পা-ওয়ালা খুনি জন্তুটা। রাতের পর রাত চলল এই হত্যাকাণ্ড আর রেড কিলার নামধারী জন্তুটার মাথার উপর পুরস্কারের অঙ্কটাও বেড়ে চলল অবিশ্বাস্যভাবে। পুরস্কারের লোভে আরও অনেক শিকারি এসে জুটল। কিন্তু ওই লাল রং-এর শয়তান জন্তুটার অসাধারণ ধূর্ত স্বভাব ও ক্ষিপ্রতার কাছে সকলেই হার মানতে বাধ্য হল।
ওয়ারুনার মালিক যখন হতাশ হয়ে পড়েছেন, তখন হঠাৎ একদিন অকুস্থলে আবির্ভূত হল এক ওস্তাদ শিকারি। এই লোকটি সাদা-চামড়ার মানুষ নয়, অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসী এক বর্ণসংকর। স্থানীয় শিকারিটির নামডাক ছিল যথেষ্ট, কিন্তু ওয়ারুনার মালিক তখন প্রায় সকলের উপরই আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তবু স্থানীয় শিকারিটি যখন মালিকের কাছে এসে খুনি কুকুরটাকে মারার প্রস্তাব করল, তখন ওয়ারুনার মালিক তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন না।
মালিককে একটিমাত্র প্রশ্ন করলে স্থানীয় শিকারি গুড় আছে?
মালিক বললেন, আছে।
শিকারি গম্ভীরভাবে বলল, তাহলে আর ভাবনা নেই।রেড কিলার এইবার নির্ঘাত মারা পড়বে।
শিকারির নির্দেশ অনুসারে সেই রাত্রে ভেড়াগুলোকে খোঁয়াড়ের ভিতর না-রেখে প্রান্তরের। উপরই ছেড়ে দেওয়া হল। ওই প্রান্তর বা মেষচারণ ভূমির চারপাশে অবশ্য লৌহজালের বেষ্টনী ছিল, কিন্তু ওই জাল কেটে ভেড়া মারতে রেড কিলার কোনোদিনই অসুবিধা ভোগ করেনি। সেই রাতেও ভেড়াগুলোকে প্রান্তরের উপর রেখে শয্যা আশ্রয় করার আগে ওয়ারুনার মালিক ভেবেছিলেন পরের দিন সকালে উঠে নিশ্চয়ই তিনি কয়েকটা ভেড়ার মৃতদেহ দেখতে পাবেন।
হ্যাঁ, মৃতদেহ তিনি দেখেছিলেন বটে, তবে সেটা ভেড়ার মৃতদেহ নয়।
খুব ভোরেই উঠেছিলেন তিনি।
অনুসন্ধান করতে করতে লোহার-জালে-ঘেরা বেষ্টনীর বাইরে এক জায়গায় একটা ডিংগোর মৃতদেহ তার এবং অন্যান্য অনুসন্ধানকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
কাছে এগিয়ে গিয়ে তারা দেখলেন জন্তুটা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার জান্তব বিভীষিকা রেড কিলার!
শিকারি তার কথা রেখেছে!
বহু শিকারি বহুদিন ধরে চেষ্টা করেও যা করতে পারেনি, স্থানীয় মানুষটি সেই অসাধ্য সাধন করেছে–ওয়ারুনা উপত্যকার বুক থেকে তার চেষ্টাতেই বিদায় নিয়েছে শরীরী মৃত্যুর এক জান্তব অভিশাপ!