এমন বৃহৎ বপু ডিংগো-কুকুর ইতিপূর্বে অশ্বচালকের দৃষ্টিগোচর হয়নি। প্রায় তিন ফুট উঁচু এই সারমেয়-দানবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি ডিংগোর মতোই বটে কিন্তু ক্যাঙারু-হাউন্ড নামক অতি বৃহৎ শিকারি কুকুরের সঙ্গেও তার যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে।
অশ্বচালক বুঝল এই বর্ণ সংকর ভয়াবহ জন্তুটার জন্ম হয়েছে ক্যাঙারু-হাউন্ড ও ডিংগোর সংমিশ্রণে!
জন্তুটা তিন পায়ে ভর দিয়ে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এল টেরিয়ারের দিকে। লোকটি দেখল কুকুরটার বাঁ-দিকের পা নেই। কনুই থেকে কাটা ছিন্ন অংশটা এই সারমেয়-দানবের ভয়ানক চেহারাটাকে করে তুলেছে আরও ভয়ানক!
মানুষের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অতিকায় ডিংগোটা টেরিয়ার কুকুরটার কাছে এসে দাঁড়াল এবং ছোটো জন্তুটার দেহের ঘ্রাণ গ্রহণ করতে করতে অকস্মাৎ কামড়ে ধরল তার কণ্ঠদেশ–
পরক্ষণেই ঝাঁকুনির পর ঝাঁকুনি!
কুকুরের মনিব এতক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, এইবার তার সংবিৎ ফিরে এল। লোকটির কাছে স্প্যানার নামক লোহার যন্ত্র ছাড়া কোনো অস্ত্র ছিল না। পোষা কুকুরটাকে বাঁচানোর জন্য এই স্প্যানারটা নিয়েই সে ছুটে এল এবং যন্ত্রটা দিয়ে বারংবার আঘাত হানতে লাগল ডিংগোর মাথার উপর।
স্প্যানারের আঘাতে শয়তান ডিংগোটা কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না, বরং দ্বিগুণ উৎসাহে কামড়াতে কামড়াতে টেরিয়ার কুকুরটাকে সে টুকরা টুকরো করে ফেলল।
হঠাৎ ডিংগোটা যেন মানুষটির অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠল। টেরিয়ারের মৃতদেহটা ফেলে দিয়ে সে লোকটির কণ্ঠদেশ লক্ষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অশ্বচালক একহাত দিয়ে নিজের গলাটাকে বাঁচাতে লাগল এবং অন্য হাত দিয়ে স্প্যানারটা বাগিয়ে ধরে অনবরত আঘাত হানতে লাগল বুনো কুকুরটার মাথার উপর। অবশেষে ডিংগো পরাজয় স্বীকার করল, লৌহময় স্প্যানারের সুকঠিন অভ্যর্থনা আর সহ্য করতে না-পেরে জন্তুটা ঝোপের ভিতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
লোকটির অবস্থাও খুব ভালো ছিল না, ডিংগোর দন্তাঘাতে তার হাত ও মুখের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছিল অনেকগুলো ক্ষতচিহ্ন। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সেই ক্ষতস্থানগুলো সেলাই করিয়ে লোকটি সেযাত্রা রেহাই পায়।
এই ঘটনার ফলে স্থানীয় মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল তীব্র উত্তেজনা। দলে দলে অশ্বারোহী মানুষ রাইফেল হাতে বেরিয়ে পড়ল খুনি জানোয়ারটার সন্ধানে, তাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে ছিল ক্যাঙারু হাউন্ড নামক শক্তিশালী শিকারি-কুকুর। কিন্তু মানুষ ও সারমেয় বাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি ডিংগোটাকে আবিষ্কার করতে পারল না, সে হঠাৎ ওয়ারুনা উপত্যকার বুক থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন।
কিছুদিন পরেই আবার একটা ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল। উক্ত হত্যাকাণ্ডের বিবরণী থেকে জানা গেল শয়তানটা একেবারে নিঃসঙ্গ নয়, কখনো কখনো সে একাজে সঙ্গীর সাহায্য নিয়ে থাকে। ঘটনার বিবরণ নিম্নে বর্ণিত হল।
ভেড়াগুলিকে পানীয় জল সরবরাহ করার জন্য একটা কূপ নির্মাণের কাজ চলছিল। ওই কাজের পরিদর্শন ও পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন গেমেস এম ডাউনি নামক জনৈক শ্বেতাঙ্গ। একদিন সকাল বেলা ডাউনি সাহেব ঘোড়ার পিঠে চড়ে তার কর্তব্য করছিলেন, হঠাৎ তার চোখে পড়ল তৃণভূমির উপর অবস্থিত মেষপালের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য!
যে ভেড়াগুলো মাঠের উপর চরে বেড়াচ্ছিল সেই জন্তুগুলো হঠাৎ পাগলের মতো ছুটতে শুরু করল এবং মাঠের উপর শুয়ে যে ভেড়াগুলো বিশ্রাম সুখ উপভোগ করছিল তারাও যোগ দিল ধাবমান সঙ্গীদের সাথে!
তাদের উত্তেজনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রায় আধমাইল দূরে দুটো ডিংগোকে দেখতে পেলেন মি. ডাউনি। জন্তু দুটি লৌহজালের আবেষ্টনের বাইরে ঘোরাঘুরি করছিল। মি. ডাউনি বুঝলেন জালের গায়ে একটা ফুটোফাটা প্রবেশপথ আবিষ্কার করার জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে ঘোড়া চালিয়ে জন্তু দুটোর দৃষ্টিসীমার বাইরে এসেই তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন মি. ডাউনি এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে উপস্থিত হলেন ওয়ারুনার সেই মালিকের কাছে, যাঁর জমির উপর প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল রেড কিলার।
মি. ডাউনির কাছে সব কথা শুনলেন ওয়ারুনার মালিক, তারপর দুজনে দুটি রাইফেল নিয়ে একটা মোটরে উঠে ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অকুস্থলে এসে তারা দেখলেন ডিংগো দুটো কোন ফাঁকে ভিতরে ঢুকে পড়েছে এবং মিলিতভাবে একটা ভেড়াকে আক্রমণ করে তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে।
মি. ডাউনি গুলি চালালেন। দুটো জন্তুর মধ্যে অপেক্ষাকৃত বড়ো কুকুরটা তিনটি মাত্র পা নিয়েই অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে ছুটল লোহার জালের গায়ে অবস্থিত একটা ফোকর লক্ষ করে এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ফুটোটার ভিতর দিয়ে শরীরটা গলিয়ে দিয়ে অপর দিকে লাফিয়ে পড়ল। তবে এই যাত্রা তাকে কিছুটা শাস্তিগ্রহণ করতে হল, ডাউনির রাইফেলের গুলি তাকে মাটির উপর শুইয়ে দিল। মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য জন্তুটার চৈতন্য লোপ পেয়েছিল, তারপরই সে ভূমিশয্যা ছেড়ে তিন পায়ের উপর ভর দিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে শিকারিদের দৃষ্টিসীমার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আসল আসামি হাতছাড়া হয়ে গেল দেখে শিকারিরা এইবার দুনম্বর কুকুরটার দিকে নজর দিলেন।