জমি পরীক্ষা করে দেখা গেল একটা ভীষণ লড়াই হয়েছে। আক্রমণকারীর কবল থেকে গোরুটা তার বাছুরকে রক্ষা করার জন্য খুবই চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার চেষ্টা সফল হয়নি। আক্রমণকারী জীবটি গোরুটার পিছনের পায়ের একটি শিরা কেটে তাকে অকর্মণ্য করে অসহায় বাছুরটাকে হত্যা করেছে। গোরুটা যে শুধু খোঁড়া হয়ে চলৎশক্তি হারিয়েছে তাই নয়, উপরন্তু তীক্ষ্ণ দন্তাঘাতে তার সর্বাঙ্গ হয়েছে রক্তাক্ত এবং লাঙ্গুলের অর্ধ-অংশ হয়েছে বিচ্ছিন্ন! হত্যাকারী বাছুরটার মাংস ভক্ষণ করেনি, কিন্তু নিহত গো-শাবকের হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে।
দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও গোয়ালের ভিতর হত্যাকারীর প্রবেশ ঘটল কীভাবে?
অনুসন্ধানের ফলে জানা গেল বেড়ার গায়ে ফুটো করে হত্যাকারী ভিতরে ঢুকেছিল এবং জমির উপর পদচিহ্ন পরীক্ষা করে সকলেই বুঝল, যে হিংস্র শ্বাপদ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী সে মাত্র তিনটি পা-র অধিকারী; অর্থাৎ এবারের হত্যালীলার জন্যও দায়ী হচ্ছে রেড কিলার!
তিনটি মাত্র ঠ্যাং-এর ওপর ভর দিয়েই খুনি জানোয়ারটা আবার হত্যার আসরে আবির্ভূত হয়েছে।
এই ঘটনার পর স্থানীয় পশুপালক ও মেষরক্ষকরা অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়ল।
অস্ট্রেলিয়ার গভর্নমেন্ট হঠাৎ ডিংগো সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠলেন। এই বুনো কুকুরগুলো প্রতি বৎসরই বহু মূল্যবান মেষ হত্যা করে, ফলে পশম রপ্তানি হয় অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত এবং গভর্নমেন্টকেও বেশ কিছুটা আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হয়।
–অস্ট্রেলিয়ার গভর্নমেন্ট এই সময়ে প্রতি ডিংগোর মাথা পিছু তিন পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করলেন। সরকারের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্বে উল্লিখিত ওয়ারুনার পশুপালকও রেড কিলার-এর মাথার উপর পাঁচ পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করলেন। উক্ত পশুপালকের দুই প্রতিবেশীও জানালেন জন্তুটাকে যে হত্যা করতে পারবে তাকে পুরস্কার দিতে তারাও রাজি আছেন।
সব নিয়ে মোট পুরস্কারের অঙ্ক হল পনেরো পাউন্ড। টাকার অঙ্কটা খুব কম নয়।
টাকার লোভে পেশাদার শিকারিরা ডিংগোটাকে হত্যা করতে সচেষ্ট হল। কিন্তু শিকারির ফাঁদ এবং বন্দুকের গুলিকে ফাঁকি দিয়ে অদ্ভুত চাতুর্যের সঙ্গে বুনো কুকুরটা গৃহপালিত পশুদের উপর হামলা চালাতে লাগল, কিছুতেই তাকে জব্দ করা গেল না। বিষাক্ত মাংসের টোপ দিয়েও তাকে প্রলুব্ধ করা যায়নি; রাতের পর রাত জেগে গাছের উপর পাহারা দিয়েছে বন্দুক হাতে শিকারির দল, কিন্তু কুরকুরটা তাদের অনায়াসে ফাঁকি দিয়েছে বারংবার!
রেড কিলার-এর উদ্দেশে পাতা ফাঁদের মধ্যে ধরা পড়ল ক্যাঙারু, ওয়ালবি প্রভৃতি জানোয়ার, এমনকী কয়েকটা ডিংগোও শিকারিদের ফঁদে ধরা পড়েছিল কিন্তু যার জন্য এত আয়োজন সেই তিন-পা-ওয়ালা শয়তানটা কোনো ফাঁদের আলিঙ্গনে বন্দি হল না, একটা পা হারিয়ে জন্তুটা অসম্ভব সতর্ক হয়ে গেছে।
হঠাৎ একদিন গা-ঢাকা দিল অস্ট্রেলিয়ার লাল আতঙ্ক। দীর্ঘদিন ধরে জন্তুটার কোনো খোঁজখবর না-পেয়ে পশুপালকরাও নিশ্চিন্ত হলেন–গোরুভেড়ার অকালমৃত্যুতে তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আর রইল না।রেড কিলার নামক জন্তুটার কথা লোকে প্রায় ভুলেই গেল…
খুনি জন্তুটা আবার যেদিন নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করল সেই ভয়াবহ দিনটির কথা একটি মানুষের স্মৃতির কোঠায় চিরদিনই বিরাজ করবে ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের মতো।
ওয়ারুনার জনৈক অশ্বচালক একদিন ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে একটা মেষ-চারণভূমিতে এসে থামল এবং গাড়ি থেকে নেমে উক্ত ঘাসজমির আগাছা পরিষ্কার করতে শুরু করল।
ঘোড়ায়-টানা গাড়িটার পিছন পিছন লোকটিকে অনুসরণ করে পোষা টেরিয়ার কুকুরটিও সেখানে এসে উপস্থিত হল। কুকুরটাকে তার প্রভু খুবই ভালোবাসত, তাই জন্তুটাও সহজে প্রভুর সান্নিধ্য ত্যাগ করতে চাইত না।
হঠাৎ টেরিয়ার কুকুরটার হিংস্র গর্জন শুনে তার মালিক চমকে উঠল। লোকটি অবাক হয়ে দেখল কুকুরটার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে এবং তার সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে নিকটবর্তী ঝোপটার দিকে। লোকটি উঠে গিয়ে ঝোপের ভিতরটা দেখে এল, কিন্তু একটা গিরগিটি ছাড়া কুকুরটার ক্রোধের উদ্রেক করতে পারে এমন কোনো জীবের সাক্ষাৎ পেল না। ফিরে এসে লোকটি আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করল।
একটু পরেই আবার টেরিয়ার কুকুরটা সশব্দে মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এবার কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে ক্রোধ বা বিরক্তির আভাস ছিল না, দারুণ আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে কুকুরটা আর্তনাদ করছিল রুদ্ধস্বরে!
লোকটি অবাক হয়ে ভাবল ঝোপের ভিতর তো কিছুই নেই, তবে জন্তুটা এত ভয় পেল কেন? একবার ঝোপের ভিতর পর্যবেক্ষণ করে লোকটি কিছুই দেখতে পায়নি, তাই এবার সে কাজ ছেড়ে টেরিয়ার কুকুরটার আতঙ্কের কারণ অনুসন্ধান করতে এগিয়ে গেল না। একটু পরে কাজ শেষ করে সে ঘোড়াগুলোর মুখ ঘুরিয়ে গাড়িটাকে ঘাসজমির অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার উদযোগ করল আর ঠিক তখনই ঝোপটার দিকে হঠাৎ নজর পড়তেই সে টেরিয়ার কুকুরটার আতঙ্কের কারণটা বুঝতে পারল।
ঝোপের ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে একটা অতিকায় ডিংগো! লালচে-বাদামি রং-এর ডিংগোটার জ্বলন্ত দুই চক্ষুর হিংস্র দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে টেরিয়ার কুকুরটার দিকে।