এই রক্তাক্ত ও ভয়াবহ দৃশ্যের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে অশ্বারোহী ঘোড়া ছুটিয়ে চলল তার আস্তানার দিকে…।
দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে একটু পরেই সদলবলে অকুস্থলে উপস্থিত হলেন ওয়ারুনার মেষপালের মালিক। তাঁর নির্দেশে মৃত জন্তুগুলির রোমশ চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে মাংসপিণ্ডগুলিকে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে সমর্পণ করা হল। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কে বা কারা দায়ী সে-কথা বুঝতে অবশ্য কারো অসুবিধা হয়নি; কারণ অস্ট্রেলিয়ার অরণ্যে একমাত্র বিভীষিকা হচ্ছে ডিংগো (Dingo) নামক একধরনের বুনো কুকুর–বাঘ, ভালুক, সিংহ প্রভৃতি শ্বাপদ এখানে অনুপস্থিত। ডিংগোর আক্রমণে প্রতি বৎসরই বহুসংখ্যক মূল্যবান ভেড়া প্রাণ হারায়, তাই অস্ট্রেলিয়ার মেষপালকরা বাধ্য হয়ে বিস্তীর্ণ তৃণভূমির চারদিক লোহার জাল দিয়ে ঘিরে ভেড়াগুলিকে ওই আবেষ্টনের ভিতর ছেড়ে দেয়। ওয়ারুনার মালিকও ভেড়াগুলিকে লোহার জাল দিয়ে ঘিরে নিশ্চিন্ত ছিলেন। কিন্তু পূর্বোক্ত আবেষ্টনের ভিতর যে ষাঁড়টা ছিল সে একদিন তো মেরে লোহার জালের একস্থানে ছিদ্রের সৃষ্টি করল। ডিংগোটা সেই ফাঁক দিয়ে ভিতরে এসে এক রাতের মধ্যেই তেইশটা স্ত্রীজাতীয় মেষ ও মেষশাবকের প্রাণ হরণ করে। নিহত মেষগুলির দেহ পরীক্ষা করে দেখা গেছে মাত্র চারটি ভেড়ার কিডনি ভক্ষণ করেছে জন্তুটা, অন্য ভেড়াগুলিকে সে হত্যা করেছে কেবল হত্যার আনন্দ চরিতার্থ করার জন্যে।
যে-ষাঁড়টা লোহার জালে ঢুঁ মেরে বেড়া ভেঙে ফেলেছিল এবং যার জন্য এতগুলো মূল্যবান ভেড়ার প্রাণহানি ঘটল, সেই হতভাগা ষাঁড়টাকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হল। তারপর ছিদ্রটাকে ভালো করে মেরামত করিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন ওয়ারুনার মেষপালের মালিক।
কিন্তু ছয় সপ্তাহ পরেই একদিন সকালে জনৈক অশ্বারোহী মেষরক্ষক লোহার জালের গায়ে একটা ফুটো দেখতে পায়। পরীক্ষা করে দেখা গেল ধারালো দাঁতের সাহায্যে লোহার জাল কেটে ওই ছিদ্র সৃষ্টি করা হয়েছে!
অকুস্থলে এসে ছাদাটা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন ওয়ারুনার মালিক। ওই শক্ত লোহার জাল দাঁত দিয়ে কেটে ফেলা ডিংগোর পক্ষে প্রায় অসম্ভব, কিন্তু এই শয়তান ডিংগোটা অসম্ভবকেও সম্ভব করে ফেলেছে!
যে-ডিংগোটা জাল ফুটো করেছে পূর্ববর্তী হত্যাকাণ্ডের জন্য যে সেই জন্তুটাই দায়ী এ-বিষয়ে মালিকের সন্দেহ ছিল না; কারণ ডিংগো-চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যেখানে একবার সে শিকার সংগ্রহ করে সেখানে আবার সে ছয় সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসবেই আসবে। এখানেও দ্বিতীয়বার জন্তুটার আবির্ভাব ঘটেছিল ছয় সপ্তাহের মধ্যে এবং ভিতরে প্রবেশ করার জন্য সে একই উপায় অবলম্বন করেছিল। অতএব অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই অনুমান করতে পারবেন যে একটা জানোয়ার বার বার এখানে হামলা করতে আসছে এবং এই ভয়ানক ডিংগোটার কাছে লোহার জালও দুর্ভেদ্য নয়!
মালিক বুঝলেন, জন্তুটা ভয়ংকর শক্তিশালী, অবিলম্বে এই খুনিটাকে শেষ করতে না-পারলে তাঁর পোষা ভেড়াগুলিকে তিনি রক্ষা করতে পারবেন না।
জালের ফুটো মেরামত না-করে ওয়ারুনার মালিক ফুটোর মুখে একটা ইস্পাতের ফাঁদ সাজিয়ে রাখলেন। শুধু তাই নয়, কয়েকটা নিহত ভেড়ার কিডনিতে বিষ মাখিয়ে সেই বিষাক্ত কিডনিগুলোকে আশেপাশে ছড়িয়ে দেওয়া হল। মালিক সেই রাত্রে নিশ্চিন্ত হয়েই শয্যা আশ্রয় করেছিলেন, পরের দিন সকালে উঠে তিনি যে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ডিংগোটাকে দেখতে পাবেন এ-বিষয়ে তার একটুও সন্দেহ ছিল না।
কিন্তু পরের দিন সকালে ফাঁদের কাছে এসে ওয়ারুনার মালিক হয়ে গেলেন হতভম্ব!
বিষাক্ত কিডনিগুলোকে স্পর্শও করেনি জন্তুটা, কিন্তু ফাঁদের মধ্যে আটকে রয়েছে লালচে-বাদামি রং-এর একটা কুকুরের ঠ্যাং!
ব্যাপারটা কী হয়েছিল খুব সহজেই অনুমান করা যায়–ফাঁদের মধ্যে আটকে গিয়েছিল ডিংগোর একটা পা এবং প্রাণপণ চেষ্টাতেও শ্রীচরণকে ফাঁদের করাল দংশন থেকে মুক্ত করতে না-পেরে দাঁত দিয়ে চিবিয়ে পা-টিকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে পলায়ন করেছে ডিংগো!
ফাঁদের মধ্যে আটকানো কাটা ঠ্যাংটার লালচে বাদামি রং দেখে স্থানীয় অধিবাসীরা জন্তুটার নাম রাখল রেড কিলার বা লাল খুনি!
কিছুদিন ধরে স্থানীয় মানুষ জন্তুটাকে নিয়ে মাথা ঘামাল; ওই লাল রং-এর খুনি জানোয়ার আবার ভেড়ার দলের উপর হানা দেবে কি না এই নিয়ে মেষরক্ষকদের মধ্যে চলল তুমুল তর্ক ও আলোচনা কিন্তু পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেও যখন কুকুরটা আর আত্মপ্রকাশ করল না তখন সকলে তার কথা ভুলে গেল…
কিন্তু হঠাৎ একদিন স্থানীয় পশুপালক ও মেষরক্ষকদের গতানুগতিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করে ওয়ারুনা উপত্যকার বুকে আবার হানা দিল মূর্তিমান অভিশাপের মতো রেড কিলার!
..প্রতিদিনের অভ্যাস অনুযায়ী এক ব্যক্তি তার গোরুটাকে দোহন করে দুগ্ধ সংগ্রহ করতে এসেছিল। দুধের বালতি হাতে নিয়ে গোয়ালের দরজাটা সে খুলে ফেলল, সঙ্গেসঙ্গে স্তম্ভিত বিস্ময়ে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল–তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এক ভয়াবহ দৃশ্য!
রক্তাক্ত দেহে জিভ বার করে অতিকষ্টে নিশ্বাস ফেলছে গোরুটা এবং তার সামনেই প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে আছে একটা ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত গো-বৎস!