অনেকক্ষণ পরীক্ষা করার পর মহিষ ফিরে গেল। লোকটি তখনও ধরাশয্যা ত্যাগ করার চেষ্টা করল না। ভালোই করল, কারণ, একটু দূরে গিয়েই আবার ফিরল মহিষ। আগের মতোই শায়িত মনুষ্যদেহের চারপাশে চলল মহিষাসুরের আস্ফালন, পরীক্ষা-নিরীক্ষণ, তারপর আবার ফিরে অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করল জন্তুটা।
সাহেবের সর্বাঙ্গ দিয়ে তখন ঘাম ছুটছে। তিনি এতক্ষণে বুঝেছেন কেন অ্যাংকোলে জাতি এমন বিপজ্জনক পদ্ধতিতে মহিষ শিকার করে। তিরের বিষ মহিষের দেহে প্রবেশ করার অনেক পরে তার মৃত্যু হয়। এক-শো ফুটের বেশি দূর থেকে তির ছুঁড়ে মহিষকে কাবু করা সম্ভব নয়–কারণ, দূরত্ব বেশি হলে নিক্ষিপ্ত তিরের আঘাত করার ক্ষমতা কমে যায়। এক-শো ফুটের মধ্যে গাছে উঠে মহিষকে আঘাত করাও অসম্ভব–তিরের নাগালের মধ্যে আসার আগেই মহিষের দৃষ্টি বৃক্ষে উপবিষ্ট শিকারির দিকে আকৃষ্ট হবে এবং সে সবেগে স্থান ত্যাগ করবে, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। মাটিতে দাঁড়িয়ে কোনো গোপন স্থান থেকে মহিষকে তিরবিদ্ধ করলে শিকারির মৃত্যু অনিবার্য; মহিষের তিনটি ইন্দ্রিয়ই শক্তিশালী চক্ষু-কর্ণ-নাসিকার ত্র্যহস্পর্শ যোগে মহিষ চটপট শিকারির অস্তিত্ব আবিষ্কার করে তার দিকে ধাবিত হবে এবং তিরের বিষ মহিষের রক্তে সঞ্চারিত হয়ে তার মৃত্যু ঘটানোর আগেই তীক্ষ্ণ শিং আর খুরের আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত এক মাংসপিণ্ডে পরিণত হবে শিকারির দেহ! ছুটে পালানো সম্ভব নয়, মানুষ আর মহিষের দৌড় প্রতিযোগিতায় মানুষের জয়লাভের কোনো আশাই নেই!
মৃতদেহের প্রতি মহিষের অহিংস মনোভাবের সুযোগ গ্রহণ না-করলে অ্যাংকোলে-শিকারির পক্ষে অন্য কোনো উপায়ে মহিষ-মাংস সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, সেইজন্যই ধনুর্বাণ-সম্বল অ্যাংকোলে জাতি এমন বিপজ্জনকভাবে মহিষ শিকারে প্রবৃত্ত হয়।
আচ্ছা, এইবার কাহিনির পূর্ব সূত্র ধরে দেখা যাক আমাদের পরিচিত অ্যাংকোলে-শিকারির ভাগ্যে কী ঘটল। মহিষ আরও কয়েকবার শিকারির কাছে এসে ফিরে গেল–পাঁচ-পাঁচ বার ওইভাবে ছুটোছুটি করার পর মহিষ যখন আরও একবার ঘুরে আসছে, সেই সময় সাহেব দেখলেন জন্তুটা হঠাৎ হাঁটু পেতে বসে পড়ল–তারপর এক ডিগবাজি খেয়ে সশব্দে শয্যাগ্রহণ করল মাটির ওপর, আর উঠল না।
সাহেব বুঝলেন মহিষের মৃত্যু হল, এতক্ষণ পরে কার্যকরী হয়েছে তিরের বিষ!
মহিষের মৃতদেহ থেকে প্রায় পনেরো ফুট দূরে শায়িত একটা নিশ্চল মনুষ্যমূর্তি হঠাৎ সচল হয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর দূরবর্তী মহিষফুথের প্রস্থানপথের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সর্বাঙ্গ থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলল এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো টান করে আড়ষ্টভাব কাটিয়ে নিয়ে বাঁ-হাতে আটকানো খাপ থেকে ছুরিটা টেনে নিল। বৃদ্ধাঙ্গুলির উপর একবার ছুরির ধার পরখ করে নিয়ে অ্যাংকোলে-শিকারি তার পরবর্তী কর্মসূচি অনুসরণ করতে উদ্যত হল।
গাছ থেকে নেমে কম্যান্ডার সাহেব যখন লোকটির কাছে এসে পৌঁছালেন, সে তখন অভ্যস্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে জোবির মৃতদেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত। লোকটির ভাবভঙ্গি দেখে সাহেবের মনে হল সে যেন খুব সহজভাবে একটা দোকানে বসে কসাই-এর কর্তব্য করছে তার নির্লিপ্ত আচরণ দেখে কে বলবে একটু আগেই তার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছিল মূর্তিমান মৃত্যুদূত।
লোকটি মাথা না-তুলেই সাহেবের উপস্থিতি অনুভব করল, নিবিষ্ট চিত্তে মৃত পশুর চামড়াতে ছুরি চালাতে চালাতে সে বলল, একটু পরেই আমার পরিবারের সবাই এখানে এসে পড়বে। সূর্য ডুবে যাওয়ার আগেই এই চমৎকার মাংস তারা ঘরে নিয়ে যাবে।
সাহেব বললেন, কিন্তু জোবির বদলে যদি তারা তোমার মরা শরীরটা পড়ে থাকতে দেখত, তাহলে কী হত?
নির্বিকারভাবে শিকারি উত্তর দিল, তাহলে আমার পরিবারের লোকরা ছেঁড়াখোঁড়া শরীরের টুকরোগুলো নিয়ে গ্রামের পিছনে পুঁতে ফেলত। ওইখানে কোনো খারাপ প্রেতাত্মা যায় না।
[বৈশাখ ১৩৭৬]
অস্ট্রেলিয়ার লাল আতঙ্ক
পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ওয়ারুনা উপত্যকার বুকে একদিন প্রভাতের শান্ত নীরবতা ভঙ্গ করে জেগে উঠল মেষশাবকের করুণ আর্তস্বর!
পূর্ব দিগন্তে সবেমাত্র আত্মপ্রকাশ করেছে প্রভাতসূর্য, এমন সময়ে পূর্বোক্ত মেষশাবকের আর্তনাদ লক্ষ করে এগিয়ে এল এক অশ্বারোহী মেষরক্ষক।
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে মেষরক্ষক চতুর্দিক নিরীক্ষণ করল, তারপর ঘোড়া থামিয়ে সে অবতীর্ণ হল মাটির ওপর।
একটি মেষশাবক কাতর স্বরে আর্তনাদ করতে করতে তার দিকে এগিয়ে এল, কিন্তু অশ্বারোহী তার দিকে নজর দিল না–
চতুর্দিকে অবস্থিত মেষপালের দিকেই নিবদ্ধ হয়েছে অশ্বারোহীর দৃষ্টি।
হ্যাঁ, ভেড়ার দলটা সেখানেই ছিল। যে বিস্তীর্ণ তৃণভূমিকে লোহার জাল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে তারই মধ্যে এককোণে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে একদল ভেড়া; হঠাৎ দেখলে মনে হয় কোনো অদৃশ্য মেষপালক জন্তুগুলিকে ওইভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
পূর্বোক্ত তৃণভূমির উপর আরও যে ভেড়াগুলির দিকে অশ্বারোহীর দৃষ্টি পড়েছে তারা কিন্তু এক জায়গায় দণ্ডায়মান নয়! ঘাসজমির উপর এখানে-ওখানে ছড়িয়ে থাকা কুড়িটা ভেড়ার মধ্যে অধিকাংশের দেহেই প্রাণের চিহ্ন নেই, দু-একটা জন্তু কেবল মৃত্যুযাতনায় ছটফট করছে! চারদিকে খালি রক্ত আর রক্ত–অদৃশ্য আততায়ী রাতের অন্ধকারে হত্যালীলা চালিয়ে আবার অন্ধকারেই আত্মগোপন করেছে।