মুশতাক ও বুলার নীরব কান্না অব্যাহত থাকে। জাহাঙ্গীর ফের বলে, মুশতাক সাহেব, আপনি কষ্ট কইরা বুলারে একটু পৌঁছাইয়া দেবেন?
বুলা বলে, চলো, আর দশ-পনেরো মিনিট পরে একসঙ্গে যাই।
‘না, না’ উনারে একলা ফালাইয়া যাইবা? থাকো না কিছুক্ষণ থাকো।
ছ’টার পরে থাকতে দেবে না। চলো।
আরে রাখো। কে থাকতে দেবে না? জাহাঙ্গীরের আবার কলেজের এ্যাথলেটিক সেক্রেটারি হয়ে যাবার উপক্রম হয়, ক্যাঠায় কি কইবো, আমি মেট্রনরে বইলা যাই।
ভেসপায় স্টার্ট দিতে দিতে জাহাঙ্গীর শিস দেয়, হাম নোম এক কামরেমে বন্ধ হায় আওর চাবি খো যায় হাতের মুঠোয় স্পিড দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে আসে মতিঝিল। অফিরে কথাটা যখন বলেছে এদিকে একবার ঘুরে যাওয়াটা উচিত অফিরে সামনে একটা চক্কর দিয়ে বাঁদিকে গিয়ে স্টেডিয়ামের পেছন দিয়ে বায়তুল মোকাররেম পেছনটাকে বাঁয়ে রেখে জাহাঙ্গীরের ভেসপার চাকাজোড়া মোড় নিলো বিজয়নগরের রাস্তায়। এই রাস্তার শেষ মাথা ট্রাফিক সিগন্যালের লাল আলো জ্বলে উঠলে জাহাঙ্গীর ভেসপা থামায়। এটার দরকার ছিলো না, কারণ সে তো যাচ্ছে বাঁদিকে। তবে ধীরেসুস্থে যাওয়াই ভালো। কাকরাইলের মোড় ঘুরে শান্তিনগর চৌরাস্তা এসে সিগন্যালে নীল আলো থাকা সত্ত্বেও ওর স্পিড একেবারে জিরোতে নামে বু মালীবাগের পুলিশ বক্স এসে পড়ে। পুলিশ বক্সে একটা সামনে গিয়ে জাহাঙ্গীর ভেসপা থামিয়ে রাস্তায় নামে। পুলিশ বক্সের বারান্দায় কেউ নেই। ভেতরে?, ভেতর কোনো মহিলা-পুলিশ নেই। তার শরীর স্বস্তির হাওয়া খেলে। লু ভালো করে দ্যাখা দরকার। বারান্দায় উঠলে একজন পুলিশ বলে, কি ভাই? জাহাঙ্গীর বলে, টেলিফোন করবো। টেলিফোন নষ্ট। জানলা দিয়ে ভেত্রটা ভালো করে দেখে জাহাঙ্গীর ভেসপায় ফেরে। নাঃ ভালোই হলো। মেয়েটা থাকলেই বা কি হতো? ওর সঙ্গে জীবনে কোনোদিন সে কথাও বলেনি। এর মধ্যে একদিন এদিক দিয়ে যাবার সময় দ্যাখে কি, আরো কয়েকজন মহিলা-পুলিশের সঙ্গে ট্রাকে ওঠার সময় তার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। তা তো হতেই পারে। যারা কলেজে তাকে হিপ হুপরে বলে সাউন্ড মারতো জাহাঙ্গীর তাদের একজন গৌণসদস্য ছিলো। তো, এখন দ্যাখা হলেই বা তাকে কি বলতো? কলেজে থাকতেই কথা বলা হোল না, আর এ্যাদ্দিন পর এখন সে কি বলবে? তা বলতে পারতো, আমাকে চিনলেন না? এখনো কি মস্তান পোলাপানের দলে পেছনে দাঁড়িয়ে মেয়েদের টিটকারি দেন নাকি? এখন কিন্তু আমি এ্যারেস্ট করতে পারি, জানেন? তা এ্যারেস্টেড হতে ওর আপত্তি কি? তার ওরা না হয় ট্রাকের ওপর উঠেই কিছুক্ষণ গল্প করতো। আর কিছু না হোক বাংলার ইয়াসিন স্যারের তোতলামো নিয়ে হাসাহাসি করতে পারতো। না, এতোকাল পর ইয়ার্কি-ফাজলামি ভালো না। —ঠিক আছ, তাহলে ওদের হিস্ট্রি পড়ালে আজম সাহেব, খুব ভালো পড়াতেন, লোকও খুব ভালো, বছর খানেকহলো মারা গেছেন, তাঁকে নিয়ে মন খারাপ করে কি আপত্তি ছিলো? আজম সাহেব কিভাবে মারা গেছেন? মনে হয় ক্যান্সার হয়েছিলো। ক্যান্সার? কোথায় বোধহয় গলায়— ট্রাকের রেলিঙে ঝুঁকে দুজন কথা বলতে, দু’জনের চোখে জল, নিজের শরীরের দিকে স্যারের কোনো খেয়াল ছিলো না। তোমার মনে নাই হিপ-হিপ দূর, নামটাও মনে নেই। নাঃ! হলো না। তারা একসঙ্গে মন খারাপ করবে কি নিয়ে?–জাহাঙ্গীরের ভেসপা চলছে ভো ভো করে। রেলগেট বন্ধ বলে ব্রেক কষতে হয়। আরে মহাখালি এসে গেছে। তাহলে গুলশান বনানীটা একবার ঘুরে আসা যায়।–গুলশান নানীর ছোটোবড়ো রাস্তাগুলো ছব্বি মতো পেছনে সরে যায়। কিন্তু শাহীন না শাহনাজ — বুলাকে সে কোন নামটা যেন বলেছে?— তার বাড়ি তো তার চেনা নেই। মেয়েটাকে একদিন দেখেছিলো স্টেডিয়ামে। একদিন কি দুদিন খালেক ভাই দেখিয়ে দিয়েছিলো, শর্টপুটে এবার মেয়েদের মধ্যে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান হবে, দেখিস। আরেকদিন খালেক ভাই আর কাউকে, না তাকে নয়, বলছিলো, আরে ওরা বাড়িতেই প্র্যাকটিস করে। গুলশানে বিরাট বাড়ি, বরকম খেলার এ্যারেজমেন্ট আছে। তা কোন বাড়ি, কার বাড়ি, কত নম্বর রোড, কতো নম্বর প্লট —কিছুই জানে না। দাঁড়াবে কোথায়? সুতরাং এ্যাবাউট টার্ন— দুই নম্বর মার্কেটের সামনে ছয়নম্বর বাস। এই বাসে করেই না জাহাঙ্গীর পালিয়ে গিয়েছিলো ওর নাছোড়বান্দা প্রেমিকার বাড়ি থেকে। সূরাং এই বাসের পেছনে সে ভেসপা চালায়। বাস যেখানে। দাঁড়ায়, সেও একটু দাঁড়ায়। কিন্তু পুরনো এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এসে ধৈর্য থাকে না। বাসটাকে ওভারটেক করে চলে যায়। একটু দূর থেকে ফার্মগেটের ওভারব্রিজের গায়ে লেখা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। কিন্তু একটি বর্ণও তার মাথায় ঢোকে না। হঠাৎ করে স্পীড বাড়িয়ে মগবাজার দিয়ে মালীবাগ এসে পড়ে। না, পুলিস বক্সের সামনে। দাঁড়িয়ে লাভ কি? মেয়েটার নামটাও যদি মনে রাখতো? তবে? সুরাং ভেসপার চাকাজোড়া তার কেবল গড়িয়েই চলে।