সকালে ঘুম ভাঙে তার বেশ দেরিতে। মুখ ধুয়ে এসে দ্যাখে চা টা সাজিয়ে অপেক্ষা করছে বুলা। এর মধ্যেই বুলার গোসল-টোসল সারা। তার ভোলা ভিজে কালো চুলের মধ্যে ফর্সা মুখটা ভারি কচি ও নিষ্পাপ। কি সুন্দর, না? ভেসপায় স্টার্ট দিতে দিতে জাহাঙ্গীর ঠিক করে, বিকাল বেলার আগেই ঘরে ফিরবে? বুলাকে ধরে ঠেসে চুমু খাবে। তারপর ওকে পেছনে বসিয়ে নিয়ে অনেক দূর ঘুরে আসবে। মালীবাগের ওদিকেটাও যাবে। পুলিশবক্সে মেয়েটা থাকলে চোখজোড়া মেলে একটু দেখবে। দ্যাখানো দরকার।
কিন্তু বিকালবেলা ভেসপার আওয়াজে বুলা বেরিয়ে এলে ওর মুখটা ভার-ভার ঠেকে। কি ব্যাপার? মুশতাক ভাই এসেছিলে। আবার মুশতাক ভাই? দূর! ফার্মেসিগুলো একবার ঢু মেরে এলে হতো, কিছু না কিছু অর্ডার কি আর পেতো না?–কেন, মুশতাক ভাই কেন? সুনীলদাকে আজ সকালে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে, মেডিক্যাল কলেজে আছে। বুলা এক্ষুণি দেখতে যাবে। জাহাঙ্গীরকেও যেতে হবে— আবার সুনীলদা। আবার মুশতাক ভাই।
আমি কি করবো? তুমি যাও।
ওমা। তাই কি হয়। সুনীলদা তোমাকে দেখবে না? আমাদের ছোটোবেলার গানের ওস্তাদ। আমাকে কি আদর করতো।
যাবো। জাহাঙ্গীর চা খেতে খেতে বলে, কিন্তু আমার তো অফিরে খুব জরুরি কাজ। তোমারে রং মেডিক্যালে নামাইয়া দিয়া যাই।
ফিরবো কি করে?
একলা আসতে পারবা না? মুশতাক সাহেব পৌঁছাইয়া দিতে পারবো না।
থাক। আমার আর গিয়ে কাজ নেই। বুলার একটু ভিজে গলার মিষ্টি স্বর ও একটু ঝাঁপসা নোনতা চোখের কোঁচকানোটা এতো সুস্বাদু লাগে যে জাহাঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গে কাৎ হয়, আচ্ছা চলো
ভেসপার পেছনে বসে বুলা কবক করে যাচ্ছিলো, কথা একবার শুরু করলে মেয়েটা থামতে পারে না। কথাও বলে এতো মিষ্টি করে, এর আগে এ রকম মিষ্টি ভাষায় কথা বলা মেয়ের সঙ্গে জাহাঙ্গীর কোনোদিন আলাপ করেনি। জাহাঙ্গীর সিনা টান করে, মাথা সোজা রেখে ভেসপা চালায়। বুলা একনাগাড়ে কতো কথা বলে। বেশির ভাগই তাদের ছেলেবেলার কথা। খুব ছেলেবেলায় তারা কুমিল্লায় থাকতো। সুনীল সেনগুপ্ত না থাকলে তার গান শেখাই হতো না।–মুশতাক থাকতো তাদের পাশের বাড়ি। তারা একসঙ্গে গান শিখেছে।–কুমিল্লা কি সুন্দর শহর, ঢাকার মতো এ রকম মানুষ গিজগিজ করে না। ঢাকায় সুনীলদার মতো তোক একটাও নেই। বেচারা বিয়েথা করেনি। এখন বয়স ষাটের কোঠায় পড়েছে, দ্যাখার লোক নেই একটাও–দ্যাখো, বিধবা বড়োবোন ও ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্যেই বিয়ে করলো না, অথচ ভাগ্নে-ভাগ্নিগুলো চাকরি নিয়ে বিয়ে করে ব ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলো ইণ্ডিয়ায়, এখন তাকে দেখবে কে? বুলাকে এতো ভালোবাসতো, এতো যত্ন করে গান শিখিয়েছে, বলতো, তুই কোনো দিন গান ছাড়িস না–সুনীলদা যদি শোনে যে বুলা গান ছেড়ে দিয়েছে তো এতো কষ্ট পাবে। জাহাঙ্গীর ভাবে, কেন? বুলা গান ছাড়বে কেন? বুলাকে তার বলতে ইচ্ছা করে, তুমি গান শিখতে চাও, শেখো। যতো টাকা লাগে আমি রোজগার করে আনবো। দরকার হলে কোথাও পার্ট টাইম কাজ নেবো। দেশের বেস্ট ওস্তাদকে রেখে দেবে। তোমার কথা এতো মিষ্টি, এই কথায় সুর দিলে না জানি কি সৃষ্টি হবে। কিন্তু এসবকথা বলাটা মুশকিল। এ ছাড়া মেডিকাল কলেজের গেট এসে পড়ে। দোতলায় ওয়ার্ডের এক কোণে নাকে অক্সিজেনের পাইপ গোঁজা রোগা সুনীল সেনগুপ্তকে দেখে জাহাঙ্গীরের বুক উথলে ওঠে হায় রে, মানুষটা একেবারে নিঃসঙ্গ শুয়ে রয়েছে। বুলা পায়ে হাত রেখে সালাম করলে জাহাঙ্গীরও নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে। সুনীল সেনগুপ্ত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে মুশতাক এসে পড়ে, তার হাতে ফ্ল্যাক্স। মুশতাক বুকে বলে, দাদা, বুলার হাজব্যান্ড, চিনতে পেরেছেন? সুনীলদার ঠোঁট কাপে, ঠোঁটে হারি কিন একটি রেখা তৈরির চেষ্টা তার ব্যর্থ হয়।
নার্স এসে টেম্পারেচার নেয়, খাটের মাথায় ঝোলানো চার্টে লেখে। স্ট্যান্ড থেকে নল বেয়ে ফোঁটা-ফোঁটা স্যালাইন কছে সুনীলদার হাতের শিরায়। জাহাঙ্গীর টুলে বসে চুপচাপ দ্যাখে। অন্য হান্দ্রে তালুতে জাহাঙ্গীর একটা হাত রাখে। সুনীলদার হাত ও আঙুল একটু একটু কাপে। আঙুল দিয়ে লোকটা জাহাঙ্গীরকে কি বলছে? হয়তো বলছে, বুলার গলা একেবারে তৈরি, গান ওর রক্তের মধ্যে। তুমি দেখো। জাহাঙ্গীরে চোখ ছলছল করে। আস্তে আস্তে উঠে দ্যাখে, বুলা কিংবা মুশতাক ঘরে নেই। কোথায় গেলো? মস্ত বড়ো ওয়ার্ডের এ-মাথা ওমাথা—কোথাও নেই। পেছনের দিককার বারান্দায় বুলার শাড়ি দ্যাখা যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর বারান্দায় যায় রেলিঙে ঝুঁকে দুজনে কাঁদছে। জাহাঙ্গীরকে দেখে বুলা কাঁদতে কাঁদতে বলে, সুনীলদার গলায় ক্যান্সার। বাঁচবে না। মুশতাকও রুমাল দিয়ে চোখ মোছে, ক্যান্সার, প্রথম দিকে ধরা পড়লেও ট্রিটমেন্ট করা যেতো। বোর কুমিল্পা গেলাম, কতো বললাম, সুনীলদা, ঢাকায় চলেন। ভালো করে ডাক্তার দ্যাখান না। একটা ভালো ছেলে পাওয়া গেছে, গলাটা এতো মিষ্টি। ওকে একটু দেখিয়ে দিয়ে তারপর যাবো।–এখন এসে কি লাভ হলো? বুলাও কাঁদতে কাঁদতে বলে, কেন? আমাদের একটা দিন কামাই দিতে দিতো না। মুশতাক ভাই, মনে নাই? জাহাঙ্গীরের ছলছল চোখ থেকে জল বাষ্প হয়ে উঠে যায়, চোখ বড়ো বড়ো করে সে এদের একই বেদনা ও একই স্মৃতির ছোঁয়াছুঁয়িটা দ্যাখে, তার চোখ খটখটে হয়ে আসে। হঠাৎ পর একটা হাত দিয়ে কি মনে পড়ে তার, বলে, বুলা, ভুল কইরা আমার অফিরে চাবি নিয়া আসছি। যাই, পিওনটারে দিয়া আসি। না হইলে কাল ওরা বিপদে পড়বে।