সবাই হাসে। জাহাঙ্গীরও হাসে, তবে ঠোঁটে হাসির দাগটা ফুটিয়ে তুলতে ওর জান বেরিয়ে যাবার দশা হয়। রাত্রে বিছানায় শুয়ে বুলা বলে, মুশতাক ভাইয়ের কথাবার্তা খুব ফ্রাঙ্ক, ঠিক তোমার মতো, না? যা মনে হয় তাই বলে। কেমন হাসালো, আজ, দেখলে না?
বহুত মজা করলো, গান বাজনা করে না?
হ্যাঁ। সরোদ বাজায়। সুনীল সেনগুপ্তের খুব প্রিয় ছাত্র। মুশতাক ভাই খুব ফিনসিয়ার আর্টিস্ট। ক্ল্যাসিক্যালের নিচে নামবে না। দেখলে না টিভির ওপর কেমন চটা?
প্রোগ্রাম না পাইলে চেতবো না? আরে একটা প্রডিউসারকে কইলেই তো প্রোগ্রাম দেয়। উনার পুরা নামটা কও তো।
না, না, উনি ইচ্ছা করেই প্রোগ্রাম নেন না। এইসব ন্যাকামো বাঁদরামো ঘাবলামো মুশতাক ভাই সহ্য করতে পারে না।
জাহাঙ্গীরের কাছে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয় না। হাজার হাজার নরনারীর সামনে নিজেকে দ্যাখাবার এরকম সুযোগ কি কেউ ইচ্ছা করে হারায়? বুলা তো মিথ্যা কথা বলে না। তাহলে সে নিশ্চয়ই ঠিকঠাক জানে না। জাহাঙ্গীর বলে, একটা দুইটা প্রোগ্রাম পাইলেই দেখবা মুশতাক ভাইও নাচতে শুরু করবো, টিভির পর্দা ফাটাইয়া ফালাইবো।
বললাম তো মুশতাক ভাই অন্য ধরনের লোক। সঙ্গীত উনার রক্তের মধ্যে, তা ইয়ার্কি মারা সহ্য করতে পারে না। বুলার কথা শুন জাহাঙ্গীর একেবারে চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর বলে, তোমার আসলে বিয়ে হওয়া উচিত ছিলো ঐসব হাই-থটের গান বাজনা করা লোকের সঙ্গে। আমি ঐগুলি বুঝি না।
বুলার যেন চৈতন্য ফিরে আসে। জাহাঙ্গীরের পিঠে হাত রেখে বলে, তুমি রাগ করলে?
না, না। রাগ করিনি। গলা খাঁকরে সমস্ত এক্সট্রা রসালো ভাব ঝেড়ে ফেলে জাহাঙ্গীর, রাগ করবো কেন? মানে আমি তো এইসব ঠিক বুঝি না। তোমাদের ঐসব গান বাজনায় আমার ইন্টারেস্ট নাই। ধরো ঐ লাইনের মানুষকে বিয়ে করলে তোমাকে হেলপ করতে পারতো। মানে একই লাইনের হাজব্যান্ড-ওয়াইফ হলে।
এসব কথা আর বলবে না। বলতে বলতে বুলা ডান হাতের চারটে আঙুল দিয়ে জাহাঙ্গীরের ঠোঁট চাপা দেয়। একটু আগে পাঙ্গাশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছে, বুলার হাতের আঁশটে নাকে থাপ্পড় মারলে নিশ্বাস বন্ধ করে জাহাঙ্গীর বুলার আদর নেয়। বুলা বলে, আমি ঠিক এই রকম লোকই চেয়েছি। এইরকম হাসিখুশি, এইরকম কাজের লোক, এইরকম ফিগার, হেঁটে গেলে মাটি কাঁপে—এই আমার ভালো।
তবে ধরো আমার পক্ষে গান বাজনার ব্যাপার–।
আবার? চোপ! বুলার হাত আরো চেপে বসে, ঐ সব লোক গুণীলোক, ওদের খুব শ্রদ্ধা করি, কিন্তু ওদের ভালোবাসা মুশকিল। বুঝলে না, রাত দিন বিছানার ওপর বসে খালি রেওয়াজ করে, বাইরে যায় না—এসব পুরুষ মানুষের সঙ্গে ঘর করা যায়?
জাহাঙ্গীরের কোনো সাড়া না পেয়ে বুলা ফের বলে, একই লাইনের হাজব্যান্ড ওয়াইফের কথা বলছো? তুমি তাহলে গুলশানের মেয়েটাকে বিয়ে করলে না কেন? এইবার বলো তো?
জাহাঙ্গীর কি বলবে? গুলশানের মেয়েটিকে বিয়ে করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবে ওরকম কোনো মেয়ের সঙ্গে সত্যি সত্যি আলাপ থাকলে মাঝে মাঝে যাওয়া যেতো। বুলাকে বলে, বোল তো, এসিব গুণীলোক কি তোমার মতো এরকম বেপরোয়া মোটর সাইকেল চালাতে পারে?
বুলার আঙুলে জাহাঙ্গীর চুমু খায়। এমন কি তার তর্জনী নিয়ে একটু একটু চুষতেও শুরু করে। বুলা ফের বলে, বলো ওরা পারে?
জাহাঙ্গীর এবার আত্মসমর্পণ করে, আমাদের হিপ-হিপরেও আমার ভেসপা চালাবার ভঙ্গি দেখেও ধরে ফেললো।
ও হ্যাঁ, গল্পটা শেষ করলে না? ভাইয়ারা এসে সব মার্ডার করলো।
মহা উৎসাহে হিপ-হিপের গল্প শুরু করলেও এবার তেমন জমে না। সেই যে সাউন্ড মারা ছেলেদের হাত থেকে উদ্ধার করে জাহাঙ্গীর তাকে রিকশায় উঠিয়ে দিলো এরপর থেকে
তা মেয়েটার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ কেটে গেলো কি করে? গল্পটা তো আগেও শোনা হয়েছে। সেই স্মৃতি থেকে বুলা এই প্রশ্ন করে।
কিন্তু জাহাঙ্গীর এবার অন্যরকম কথা বলে, যোগাযোগ বন্ধ হইবো ক্যান? না মানে ধরো, একই ক্লাসে পড়ি, রোজ দ্যাখা হয়। আবার কোনো অসুবিধা হইলে আমারেই ধরতো। বলতে বলতে জাহাঙ্গীর একটু লাজুক মতো হাসে, ছেলেরা একটু ঠাট্টাও করতো। একবার পিকনিক করতে গেলাম চন্দ্রা, আমরা কয়জন হাঁটতে হাঁটতে একটু নির্জন ঝোঁপের দিকে গেছি তো হঠাৎ দেখি, বুঝলা আমাগো দুইজনের একলা ফালায়া বিচ্ছুগুলি কৈ ভাগছে। আমরা হাসি। ইসে কয়, আরে বসোনা।
তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগলো? বুলা প্রায় উঠে বসে।
তা অস্বীকার করতে পারবো না, একটু ভালো তো লাগতোই।
সতি? ডুবে ডুবে জল খেয়েছে, না? বুলা আরো শোনবার জন্য উদগ্রীব। এই গল্পের আগেকার ভার্সনে কিন্তু জাহাঙ্গীরের সঙ্গে হিপ-হিপের এতোটা মাখামাখি বা পিকনিক—এইসব ব্যাপার ছিলো না।
আমাকে বলে, আমাদের বাসায় তো আসলেন না। আমার মা আর বড়োআপা আপনাকে দেখতে চায়।
মানে মেয়েটি তাহলে বাড়িতে ওসব বলেছে? বুলার এই উদ্বিগ্ন জবাবে জাহাঙ্গীর বলে, মনে হয়।
তুমি ওদের বাসায় গেছো?
আমি? জাহাঙ্গীর একটু ভেবে বলে, বাসায় টাসায় যাইতে ভালো লাগে না। মেয়েদের বাসায় বাসায় ঘোরা, কার্পেটের উপরে বইসা হারমোনিয়াম একখান লইয়া প্যাঁ প্যাঁ করা আমার পোষায় না।
বুলা কিছু বলে না। জাহাঙ্গীরের কথায় এ ধরনের ঝাঁঝ আগে কখনো দ্যাখেনি। জাহাঙ্গীর বলতেই থাকে, মেয়ে ক্লাসমেটের বাড়ি গিয়ে ডাক দিমু, ও মিনু, ও ডলি, একটা গান ধরো তো? তারপর শিঙাড়া, চানাচুর, চা খাইয়া ঘরে ফেরা—এইগুলি পুরুষ মানুষের কাম না, বুঝলা? এইগুলি করে হিজড়ারা, বুঝলা? হঠাৎ বেড-সুইচে খুট করে শব্দ হয়, ঝলমলে আলোয় জাহাঙ্গীর কুঁকে বুলার মুখ দ্যাখে। ফর্সা মুখ কাগজের মতো ফ্যাকাস কি হলো?