আহা, টেলিভিশনে প্রোগ্রাম পায় না। মাঝে মাঝে প্রোগ্রামের ব্যবস্থা তো সে-ই করে দিতে পারে। চেনা জানা কয়েকজন আছে, একটু ধমক দিলে বাপ বাপ করে প্রোগ্রাম দেবে। কিন্তু কথায় কিভাবে পাড়বে ভাবতে ভাবতেই মুশতাক বলে, বুলা, কেমন আছো? তোমার বিয়েতে আসতে পারলাম না। কুমিল্লা গিয়েছিলাম। জানো বোধহয় সুনীলদার শরীর খুব খারাপ।
হ্যাঁ, শুনেছিলাম। এখন কেমন?
ভালো না।
শুনে বুলার মুখটা ঝুলে পড়ে। জাহাঙ্গীর এদিক ওদিক দেখে। কে এই সুনীলদা যার শারীরিক অসুস্থতার খবরে বুলা এভাবে ভেঙে পড়ে। জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে মুশতাক, সুনীল সেনগুপ্ত। জানেন বোধহয় আমাদের দু’জনের হাতেখড়ি হয় সুনীলদার হাতে। হারমোনিয়াম ধরতে শেখায় সুনীলদা। তখন কি রাগি ছিলো, না? একটু এদিক-ওদিক হলে কিরকম ধমক দিতো মনে আছে?
আমাদের দুজনের বলতে মুশতাক কি বোঝাচ্ছে?—মানে মুশতাক আর বুলা?
–জাহাঙ্গীর একটু অস্বস্তিবোধ করে,–বুলা গানবাজনার চর্চা করে—এখবর সে জানে, কিন্তু এই ব্যাপারে তার আবার সঙ্গীও আছে একজন, সে আবার তার ভাইয়ের বন্ধু-না বুলা তো কোনদিন বলেনি। কেন বলেনি?
ধমক দেয়ার কথা কি বলছো? কিঞ্চিৎ উত্তম মধ্যম পিঠে পড়তো, সে কি ভুলে গিয়েছো? হাফিজের মাইনাস পাঁচ লেন্স ও ভাঙাচোরা গাল পেরিয়ে এই রসিকতা পড়তে না পড়তে বুলা খিলখিল করে হাসে, সেটা মুশতাক ভাইয়ের পিঠে। সুনীলদা আমাকে কখনো মারেনি।
তোমার পিঠটা অক্ষত থাকতো কারণ সুনীলদা তোমার ব্যাপারে বেশিরকম উইক। এবারে বার বার জিগ্যেস করে, বুলা রেওয়াজ করে তো? বলতে বলতে মুশতাক নিজেই প্রশ্নটা করে, রেওয়াজ করো না? আমি বললাম বুলা কি ছাড়তে পারে?
জাহাঙ্গীর উসখুস করে। হাফিজ বলে, আর গানবাজনা? মেয়েদের ব্যাপার, বোঝো না? বিয়েও হলো, গান বাজনা, পড়াশোনা সব মাথায় উঠলো। সেরকম পরিবেশ পেলে অবশ্য।
জাহাঙ্গীর এবার উঠে দাঁড়ায়, আপনারা বসেন। আমি একটু আসি। এই যাব আর আসবো, পাঁচ মিনিট।
হাফিজ বলে, বসেন। আমাদের জন্য কিছু আনতে হবে না। বুলা চা করুক। বুলার সঙ্গে জাহাঙ্গীরও রান্নাঘরে ঢোকে। এই মেয়েটাকে একটু আগে মনে হচ্ছিলো নিজেরই হাত পা নাক কানের মতো। এখন এরকম অপরিচিত মনে হচ্ছে কেন? বুলা বলে, কোথায় যাবে? ভাইয়া তো মিষ্টি নিয়েই এসেছে।
তাই হয়? মেহমানের খাবার দিয়া মেহমানদারী চলে? দেখি হায়ানের দোকানে যাই। পাঁচটা মিনিটও লাগবে না।
বাদ দাও। আমি চা করি, তুমি বরং ওদের সঙ্গে গল্প করো। গল্পে সুবিধা করতে পারছে না বলেই জাহাঙ্গীর তাড়াতাড়ি বাইরে যেতে চাইছে। তুমি চা পরে কইরো। আমি দেখতে-দেখতে ব্যাক করুন। বলে জাহাঙ্গীর আরো একবার বাথরুমে যায়। তারপরে বসার ঘরে ঢুকে ঠুক চুক শব্দ করে ক্যাসেট বদল করে টেপরেকর্ডার চালিয়ে দিয়ে বলে, গান শোনেন। মাহমুদ শাহেদের এই রেকর্ড খুব হিট করেছে। আমার ফ্রেন্ড। টিভিতে উইকে দুইটা তিনটা প্রোগ্রাম করে। বাংলা ভাষায় পপ গান বিকট জোরে বাজে; পা পাছা পিঠ ও ঘাড় দোলাতে দোলাতে জাহাঙ্গীর উঠে বাইরে। যায় তার ভেসপায় স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ এই উচ্চকণ্ঠ ধ্বনি সমষ্টিতে একটুও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না।
কাঁঠাল-পাতার ঠোঙা থেকে মোরগ পোলাও প্লেটে সাজানো হয়। জাহাঙ্গীর নিজেও বুলাকে সাহায্য করে। এখন কি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা শুরু করবে ভাবতে-ভাবতে জাহাঙ্গীর খেয়াল করলো যে টেপরেকর্ডারটা বন্ধ। কি ব্যাপার? মাহমুদ শাহেদের এতোগুলো গান।–কি ব্যাপার? বন্ধ কইরা দিছেন?
হ্যাঁ, কথা বলছিলাম। বুলার ভাইয়ের এই কৈফিয়ৎ জাহাঙ্গীরের আরো খারাপ লাগে। কথা বলছিলো তো আমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো কেন? মুশতাক বলে, মাহমুদ শাহেদ আপনার বন্ধু? এখন তো টপে আছে, না? এবার জাহাঙ্গীরের জড়তা কাটে, হ্যাঁ। অনেকদিনের বন্ধু। আমরা এক সঙ্গে একই ক্লাবে খেলাধুলা করছি। এখন এতো ফেমাস হইয়াও পুরানো ফ্রেন্ডদের ভোলে নাই। কলেজে আমি এ্যাথলেটিক সেক্রেটারি ছিলাম তো, আরে দুইবার ফাংশানে নিয়া গেছি। অরে দেইখা আর সব গান ক্যান্সেল করতে হইলো। পোলাপানে আর কিছু শুনতে চায় না। অর গান শুইনা সমস্ত হল নাচতে শুরু করলো। উই নিজেও নাচে, আমরাও নাচি। আরে অর গান শুনলে আমি তো চেক দিতে পারি না। নাচতেই হয়। মুশতাক বলে, অনেক কষ্ট করে গান করে। বেচারাদের কোমরে ব্যথা হয়ে যায়।
তা তো করেই। তবে কিনা অভ্যাস হইয়া গেছে। জাহাঙ্গীর তার প্রিয় গায়কের নৈপুণ্যে একটু গর্ববোধ করে বৈ কি!
বেচারাদের গলায় তো তেমন পরিশ্রম হয় না, সুর তালের জন্যেও কোনো পরোয়া না করলেও চলে। বেচারাদের খাটনি সব শরীরে।
হাফিজ হো-হো করে হেসে ওঠে। জাহাঙ্গীরের থতমত খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একটু সামলাবার চেষ্টা করে, কেন? টিভিতে তো দেখি বেশির ভাগই আজকাল শরীর দুলিয়ে গান করে।
সেজন্যেই ওদের গান বন্ধ করা উচিত নয়। গলা বা সুর তো এদের কাছে মাইনর ব্যাপার। তবে ধরেন গান বন্ধ করলে এদের বাত ধরে যেতে পারে।
বাত? জাহাঙ্গীর অবাক হয়, কিন্তু হাফিজ ও বুলা দুজনেই হাসতে শুরু করে। মুশতাক গম্ভীর মুখ করে বলে, ওদের গান মানে তো ফিজিক্যাল মুভমেন্ট। গান বন্ধ হলে বাত হবে না? রিকশাওয়ালাদের শেষ জীবনে কি হয়?