হ্যাঁ, শোনো। জাহাঙ্গীর নতুন উদ্যমে শুরু করে, সব সময়তার বুক উঁচু করে বলা, কাউকে কেয়ার না করা—এইসব দেখে ছেলেরা মাঝে মাঝে সাউন্ড দিতো।
সাউন্ড দিতো মানে?
আঃ। তুমি কিছু বোঝে না। স্ত্রীর অজ্ঞতায় জাহাঙ্গীরের উৎসাহ বাড়ে, সাউন্ড দিতো মানে। একটু রিমার্ক পাস করতো। তো হিপ-হিপও চেইতা যাইতো, একদিন কয় আপনাদের বাড়িতে মা বোন নেই? পোলাপান কি কম? কয়,আছে কিন্তু বাপেরা আর দুলাভায়েরা সেইগুলি দখল কইরা রাখছে।
ছি ছি! এরকম বলে, এ্যাঁ?
বুলার বিস্ময় ও ধিক্কারে জাহাঙ্গীর হাসে, যাই কও পোলাপানে ভালোই জবাবটা দিছিলো, না? হিপ-হিপ হ্বরে মেয়েটি সম্বন্ধে গল্প তার অব্যাহত থাকে। ছেলেরা একদিন করলো কি, হিপ হিপের গায়ে কলম ঝাড়ে, এবার হিপ-হিপ নালিশ করলো প্রিন্সিপালের কাছে। প্রিন্সিপ্যাল আর কি করতে পারে? ঐ ক্লাসে নিজে গিয়ে ছেলেদের খুব বকেদিলে। ছুটির পর মেয়েটির অবস্থা সেদিন খুব খারাপ ছেলেরা সব এখান থেকে সাউন্ড মারে, ওখান থেকে সাউন্ড মারে। জাহাঙ্গীর তো এসবের মধ্যে কখনো যায় না। ক্লাসও করে না, মেয়েদের পেছনে ঘোরাঘুরিও করে না। সে আছে। তার নিজের ও কলেজের খেলাধুলা নিয়ে, তার কাজ হলো কলেজের খেলাধুলার। মানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা, এই ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে তাদের কলেজের খ্যাতি যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়। আর কি করে? কলেজে কোনো বিচিত্রানুষ্ঠান এলে জানপ্রাণ দিয়ে খাটা এবং স্টেজে একবার দাঁড়িয়ে শরীরচর্চা প্রদর্শন করা। যাক, সে সেদিন ওদিক দিয়ে যাচ্ছিলো, মেয়েটা কাঁদো কাদো গলায় এসে বলে, দ্যাখোন তো। সবাই কি করছে আমার সঙ্গে? জাহাঙ্গীর বুলার কাছে তার সেদিনকার প্রতিক্রিয়ার কথা বলে, বুঝলা বুলা, আমি হাঁক দিয়া কই কি তোমরা পাইলা কি? ক্লাসমেটের সঙ্গে ইয়ার্কি মারো, রাস্তায় দেখলে তারে সাউন্ড দাও, এইগুলি কি? কলেজের বেইজ্জিতি না?
বুলা বলে তোমার সাহস তো কম না। এতোগুলো ছেলেকে বললে, সবাই মিলে তোমাকে যদি ধরতো? তোমাদের কলেজের না নামডাক।
আরে, আমারে কে কি কইবো? কলেজের আমি এ্যাথলেটিক সেক্রেটারি। মহল্লা কনেট্রাল করি আমি। ফের শুরু হলো। বুলা বলে তারপর?
তারপর কয়েকটা ছেলে এগিয়ে এসে তাকে বলে, জাহাঙ্গীর ভাই, আমাদের ধরার আগে বিচার চাই।—বিচার কিসের বিচার? তাদের অভিযোগ খুব স্পষ্ট। তাদের ক্লাসমেট প্রিন্সিপ্যালের কাছে গেলো কেন? প্রিন্সিপ্যাল সবাইকে অপমান করলো, এর বিচার করবে কে? জাহাঙ্গীর ভেবে দেখলো, তাও বটে। মেয়েটাকে সে ধমকায়, আপনে স্যারেরে কইলেন ক্যান? আমরা নাই? মেয়েটি ভ্যাবাচ্যাকা খায়, দারুণ দাপটের ডাকু টাইপের লড়কি, তার গলা কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়ে, আপনিও তাই বললেন?
বুলা জিগ্যেস করে, মানে তোমাকে আলাদা করে দ্যাখে?
আরে আমি কি ঐ বিচ্ছুগুলির লগে হাউকাউ করি? আমি ক্লাসও করতাম না, জানিই না কোন ছেমরি কি পড়ে!
ক্লাস করোনি তো বি এ পাস করেছে কিভাবে? বুলার প্রশ্নের ভঙ্গিতে জাহাঙ্গীর একটু থতমতো খায়। সাতদিন আগেও পরীক্ষার হলে ওর নকল করার বাহাদুরি নিয়ে খুব গল্প করেছে। স্যাররা ওর ভয়ে হলের ভেতর ঢুকতো না, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করে তিনটে ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে। কিন্তু এখন ঐ গল্প করতে তার একটু বাধোবাধো ঠেকছে সে তার পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যায়, আমি কই আপনে স্যারেরে কইয়া কামটা ভালো করেন নাই। পোলাপানে কয় আর জাহাঙ্গীর ভাই, আপনার কাছে কইলেও তো পারতো।
কি করি? ছেমরিটা কাঁদতে আরম্ভ করলো। আমি নিয়া রিকশায় উঠাইয়া দিলাম, তো কয়, আপনারেও যাইতে হইবো। পাগল নাকি? এক রিকশায় তার বাড়ি যাই আর একটা কেলেঙ্কারি। আমি তখন কলেজের এ্যাথলেটিক সেক্রেটারি, বুঝলা না?
গল্পটা কেবল জমে উঠেছে, এমন সময় এসে পড়ে বুলার বড়ো ভাই। হাফিজটা পুরু লেন্সের চশমা পরে। ছাত্রও খুব ভালো ফিজিক্সে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে এ্যাটমিক। এনার্জিতে ঢুকেছে, এ্যামেরিকান ইউনিভার্সিটিগুলোতে একটার পর একটা দরখাস্ত পাঠাচ্ছে, লেগে গেলেই উড়াল দেবে। এমনিতে লোকটা ভালো, যখনি আসে হাতে জাহাঙ্গীরের প্রিয় মিষ্টির প্যাকেট। তবে গভীর টাইপের এই লোকটার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের ঠিক জমে না। সম্বন্ধীর সামনে জাহাঙ্গীর সব সময় উসখুস করে। হাফিজ আজ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তার এক বন্ধুকে। এটার নকশা অবশ্য অন্যরকম, রোগা ও লম্বা, পাজামা পাঞ্জাবি, চোখে চশমা নাই। মুখে পান। হাতে সিগারটে জ্বলছে। ড্রয়িং রুমে বসেছিলো দু’জন। জাহাঙ্গীর ঢুকতেই লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ায়। বুলার ভাই নাম বলে পরিচয় করিয়ে দেয়, আমার বন্ধু, নাম শুনেছেন নিশ্চয়। সরোদ বাজায়–।
জাহাঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গে বলে, টিভিতে প্রায়ই দেখি।
হাফিজ হেসে বলে, কি মুশতাক, তুমি কি আজকাল জনগণের মনোরঞ্জনে মগ্ন নাকি?
মুশতাক ভাইকে রেগুলার প্রোগ্রাম দিলে পাবলিক চটে যাবে না? বুলা যে কখন এসেছে কেউ টের পায়নি। তার কথা শুনে মুশতাক চমকে ওঠে, একটা ঢোক গিলে হাসতে হাসতে বলে, আমাকে প্রোগ্রাম দেয় কোন শালা? তার চাকরি যাবে না?
লোকটাকে জাহাঙ্গীরের ভালোই লাগছে। আসতে না আসতে কেমন সহজ হয়ে উঠেছে।