হাসতে হাসতে বুলা হাঁপায়। জাহাঙ্গীর তেলতেলে চোখ করে বৌকে দ্যাখে। বুলাটা একেবারেই ছেলেমানুষ! অথচ এতোবড় মেয়ে, কলেজে পড়ছে আজ তিন বছর, ছাত্রীও ভালো, এসএসসি, এইচএসসি দুটোতেই সেকেণ্ড ডিভিশন। ওদের কলেজে নাকি চোথাও চলে না। অথচ দেখ কি রকম সাদাসিধা মেয়ে, যা বলা যায় তাই গোগ্রাসে গেলে। স্বামীকে বিশ্বাস করার জন্য একেবারে উদগ্রীব হয়ে আছে, শুধু কথা বলার অপেক্ষা। বিশবাইশদিন হলো বিয়ে হয়েছে, অথচ মনে হয় একে ছাড়া এতোদিন ছিলো কি করে? হাসি এবং আঁচল সামলে বুলা জিগ্যেস করে, তুমি চলে এলে তোমার মোটর সাইকেল?
জবাব দিতে জাহাঙ্গীরের এক মিনিটও দেরি হয় না, সেদিন বললাম না মাথা ধরেছিলো। মোটর সাইকেল রেখে গিয়েছিলাম।
তা তুমি ওরকম পালিয়ে এলে কেন? গুলশানে বাড়ি, গাড়ি সবই পেতে। এতো বড়োলোকের মেয়ে!
আল্লায় বাঁচাইছে! নিজের নাক ও কানে আঙুল ছুঁয়ে জাহাঙ্গীর তওবা করার ভঙ্গি করে, বড়লোকের মাইয়া বিয়া কইরা তারে কৈ রাখুম, কি খাওয়ামু। গাড়ি বাড়ির আমার দরকার নাই বাবা।? তার শেষ বাক্যটি সে আবার সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করে, গাড়ি-বাড়ি আমি নিজে করতে পারি না? হবে না? ম্যানেজিং ডিরেক্টর এইতো পরশু কইলো, জাহাঙ্গীর, অর্ডার তত ভালোই আনতাছে। গুড। দুইদিন পর পাখনা গজালেই অন্য ফার্মে যাবার তাল উঠবে। এখানেই ভালো করে কাজ করো, ফার্মটারে তোলো, তোমরাও উঠতে পারবা। এখানে সিনসিয়ারলি কাজ করলে তোমার গাড়ি বাড়ি সবই হবে। বেশিদিন লাগেনা, বুঝলা, আমাদের ইসেকে দেখলাম।
এই হলো তার স্বামীর আরেকটা দোষ। কথা বলতে বলতে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে এলো তো মূল বিষয় তার মাথায় উঠলো। এখন কোথায় গিয়ে যে থামবে। বুলা তাই স্বামীর মনোযোগ ঠিক করার জন্যে তাড়াতাড়ি বলে, তা মেয়েটার সঙ্গে তোমার আর দ্যাখা হয়নি?
পাগল। আমি আর ওদিকে যাই?
ও, এই মেয়ে তাহলে সেই পুলিশের মতো ধাওয়া করেনি, না?
পুলিশ? পুলিশ আমারে কি করবে? জাহাঙ্গীরের আত্মসম্মানবোধ আহত হয়, আরে পুলিশ আমারে বাপ ডাকছে, বুঝলা? কলেজের এ্যাথলেটিক সেক্রেটারি। আছিলাম, কলেজ তো কলেজ, কলেজের চারপাশে যতোটি মহল্লা আছে এর কোনো জায়গায় কোনো গ্যানজাম হইলে ওসি নিজে আসছে। কি ব্যাপার ওসি সাব?—জাহাঙ্গীর ভাই, কেসটা ট্যাকল করেন। আবার আমার কলেজের একটা হোস্টেলের লগে একটা সিনেমা হল আছে, পোলাপানে দুই একদিন শয়তানি কইরা মাগনা বই দেখতে চায়। ওসি আবার আসছে। এইবার কি?না জাহাঙ্গীর ভাই আপনার পোলাপানরে সামলান। আমি উল্টা ধামকি দিছি, আরে রাখেন। সিনেমার মালিক মালপানি বহুত কামাইছে, আমর পোলাপান মাগনা দুইটা সো দেখবো তো এতো হাউকাউ কিসের? —শুইনা পুলিশে কথা কয় নাই। শোনো, পুলিশের কথাই যখন তুলো তো কই।
অরে না, না! বুলা অধৈর্য হয়ে বলে, তোমায় পুলিশের ভয়ের কথা কে বললো? ঐ যে এক মহিলা-পুলিশ তোমার প্রেমে পড়ছিলো, যে সেদিন বললে না?
ও! এতোক্ষণে জাহাঙ্গীর থিতু হলো, তুমি হিপ হিপ হ্বরের কথা কও?
কি নাম বললে? বুলা হাসে, হিপ হিপ হ্বরে। মেয়েছেলের নাম?
আরে নাম না, টাইটেল, উপাধি!
ও মা! বুলা অবাক হয়, পুলিসের নাম দিয়েছিলো হিপ, হিপ হুররে?
পুলিশ তো হইলে অনেক পরে। কলেজে আমাদের সঙ্গে পড়তো। তখনি ওর হিপ দুইটা, মানে পাছা ছিলো খুব প্রমিনেন্ট, তাই দেইখা ছেলেরা টাইটেল দিলো হিপ হিপ হুররে।
মাগো! তোমরা কি অসভ্য ছিলে। ক্লাসমেটের এই নাম দিতে? এই ধিক্কার দিলেও বুলার ফের হাসির একটা ধমক আসে, কোনো রকমে নিশ্বাস টেনে নিতে নিতে বলে, তোমরা সব ভারি অসভ্যতা করতে, না?
কেন, তোমাদের কলেজের ছেলেরা তোমারে নিউ ইয়ারের টাইটেল দেয় না? ঐগুলি মনে হয় ম্যাদামার্কা খ্যাত না? বলে জাহাঙ্গীর নিজেই তার বিবৃতি সংশোধন করে, ও হো। তোমার তো উইমেন্স কলেজ, পদা-টাঙানো হারেম শরীফ। তোমাদেরটা আবার ডবল প্রোটেকটেড জোন। যা উঁচু দেওয়াল।
আব্বা আবার কো-এডুকেশন পছন্দ করে না।
তোমার বাবা একেবারে উডেন মোল্লা।
মানে?
কাঠ মোল্লা আর কি? মেয়েকে ছেলেদের সঙ্গে পড়তে দেয়নি ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়নি কে-এডুকেশনের ভয়ে, তাই না?
বুলার গলা একটু ভারি হয়, আমার বাবা কি তোমার কেউ নয়? সঙ্গে সঙ্গে জাহাঙ্গীরের আফসোস হয়, বৌ-দের কাছে তাদের বাবা-মা সম্বন্ধে একটু সাবধানে কথা বলা দরকার। ওরে আমার পিছু রানী, রাগ করলে? বুলার মাথা সামনে টেনে জাহাঙ্গীর তার গালে দুটো চুমু খায়। দুটো চুমুর পর খ্যান্ত দেওয়ার বান্দা সে নয়। তবে এখন গল্পবলার বেগ এসেছে, চুমু-টুমুর ব্যাপার পরে দেখলেও চলবে। বুলা মাথা নিচু করে বলে, আব্বা কিন্তু মোটেই কনজারভেটিভ নয়। তাহলে কি আমাকে গান শেখাতো? পাড়ার কলেজ, পড়াশোনা ভালো হয়, তাই ওখানে দিয়েছে। আচ্ছা, আমার ভুল হয়ে গেছে। এই মাপ চাইলাম। জাহাঙ্গীর হাত জোড় করে এমনভাবে তাকায় যে বুলা হেসে ফেলে। বুলা আসলে ঠিকই বুঝেছিলো। বিয়ের পর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই স্বামীটিকে সে চিনে ফেলেছে, লোকটা একেবারে খোলামেলা, মানুষ এতো ফ্রাঙ্ক হতে পারে। বাপ-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি যার সম্বন্ধে যা মনে হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেলছে। আবার দ্যাখো, বাপ-মা তো বটেই শ্বশুর সম্বন্ধেও সিরিয়াসলি কেউ খারাপ কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে রুখে দাঁড়ায়। কোথাও কোনো রাখোটকো নেই, যা বলার অকপটে বলে ফেলে। মিষ্টি-মিষ্টি মুখ করে বুলা স্বামীর দিকে তাকায়, আমি এমনি বলেছি। যাক, তারপর? তোমাদের হিপ হিপ হুররের কথা বলো।