মাগো। তুমি এতো মজা করে কথা বলতে পারো। তারপর? মেয়েটা তোমাকে কি বললো? বুলার হাসি আর থামে না, স্বামীর প্রাক-বিবাহ প্রেমের গল্প শোনে আর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে, খিলখিল এবং খিকখিক আওয়াজ বন্ধ হবার পরেও গোলগাল ফর্সা মুখের এ কোণে ও কোণে হাসির কুচি কিচিক করে। উৎসাহে জাহাঙ্গীরের ঠোঁট উপচে পড়ে, আমাকে বলে পুরুষমানুষ তার বডি হবে পুরুষ মানুষের মতো। হেঁটে গেলে মাটি কাঁপবে।
ধ্যাৎ। বুলা ফের হাসে, মেয়েরা এভাবে কথা বলে নাকি?
বললাম না, অন্য কিসিমের মাল। বলেই জাহাঙ্গীর তার ভাষা ঠিক করে, অন্য ধরনের মেয়ে। বুঝলে না? সব সময় খেলাধুলা নিয়ে থাকে আমার সঙ্গে আলাপ হয় স্টেডিয়ামে। আমি তখন ডিসকাস থ্রো প্রাকটিস করতে যাই, তো একদিন শাহীন বললো,
শাহীন কে? পরশু না নাম বললে শাহনাজ।
ঐ তো ভালোনাম শাহনাজ। ডাকনাম শাহীন। জাহাঙ্গীর একটু থেমে বলে, মানুষের দুটো নাম থাকে না? তোমার নাম–।
বুঝেছি। শাহীন না শাহনাজ। কি বললো?
আমার থ্রো দেখে বলে আপনার হাতের মুভমেন্ট খুব ম্যাজেস্টিক, আবার খুব ফাস্ট।–ওর বড়ভাই ভালো জিমন্যাস্ট ছিলো, আমাকে একদিন বলে, আপনি যদি শাহীনকে একটু দেখিয়ে দিতেন তো ভালো হয়। এবার মেয়েদের মধ্যে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন না হলে পাগল হয়ে যাবে।
তারপর?
গাড়ি করে ওদের বাড়ি নিয়ে গেলো। গুলশানের বাড়ি। বিরাট বাড়ি, সামনে লন, পেছনে মাঠ। মনে হয় হাফ স্টেডিয়াম। বাড়িতে টেনিস থেকে শুরু করে ক্রিকেট বলল, বাস্কেটবল বলো—সব কিছুর ফুল এ্যারেঞ্জমেন্ট। সুইমিং পুল পর্যন্ত আছে। একটা সাইডে শট পুট প্র্যাকটিসের জায়গা করা হলো, আমি সপ্তাহে চারদিন যাই আর। কায়দা টায়দাগুলি দ্যাখাই।
তুমি ছাড়া আর কে যেতো?
বিকাল হইলো আর লাইন দিলো মনে হয় কসকরের দুধ ছাড়তাছে।
বুলা ফের হাসে, আবার ঢাকাইয়া ল্যাঙ্গুয়েজ।
কিন্তু জাহাঙ্গীরের তখন ফ্লো এসে গেছে, এক্কেরে লাইন। বনানী,গুলশান, ধানমণ্ডির বড়োলোকের বাচ্চাগুলি গাড়ি হাঁকাইয়া আসতো। ইস্কাটন থাইকাও মনে হয় একজন আসতো।
তোমার শাহীন বোধহয় সবাইকে নাচাতো? বুলার কথায় একটু ঈর্ষার খোঁচা থাকায় জাহাঙ্গীর আরো চাঙা হয়, আরে সেগুলির একেকজনের শালা একেকরকম হুলিয়া, একেকরকম নকশা। জাহাঙ্গীর এবার অঙ্গভঙ্গি করে শাহীন বা শাহনাজের প্রেমপ্রার্থীদের চেহারা ও হাঁটবার বৈশিষ্ট্য দ্যাখায়, একটা আসতো, চিকনা, হাঁটতে গেলে হাড্ডিগুলি বাজে, চশমার আড়াল থাইকা কুকুতাইয়া চায়। শুনি সেইটা নাকি ইউনিভার্সিটিতে পড়াইতো, এইবার পরীক্ষা দিয়া ফরেন সার্ভিস পাইছে। আমি কই, এইটা ফরেন সার্ভিস দিবো। আরেকটা হোঁকা মোটা, সোজা হইয়া হাঁটতে পারে না। টেনিস র্যাকেট দুলাইতে দুলাইতে আসতো, শুনি সেটা নাকি কোনো সেক্রেটারি জয়েন্ট সেক্রেটারির পোলা। তা যতো বড় মানুষ আসুক, আমরা কি?–আমি এসবের মধ্যে নাই। আমার ডিউটি আমি করি, শর্টপুট দ্যাখাইয়া দেই। ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন করা চাই।
হয়েছিলো? সেবার ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো?
ক্যামনে হয়? আমিই তো কাইটা পড়লাম।
আবার তোমার ঢাকাইয়া শুরু হলো! বুলার এই আঁঠালো ধমকে জাহাঙ্গীর এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলে বুলা নিজেই অপ্রস্তুত হয়, হ্যাঁ, কেটে পড়লে কেন?
এর আগেও একবার বলা গল্পটার উপসংহার টানে জাহাঙ্গীর, মাঝে মাঝে গ্যাপ গেলেই স্টেডিয়ামে লোক পাঠায়। সেবার আগাখান টুর্নামেন্ট নিয়ে আমি খুব ব্যস্ত, কয়েকদিন যেতে পারিনি। তো যেদিন গেলাম, ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছি, এসে আমাকে দেখে আর কথা বলে না। কথাই বলে না। আমি বলি, চলেন প্র্যাকটিস আরম্ভ করি। হঠাৎ আমরা পাশে এসে দাঁড়ালো। জিগ্যেস করে, আচ্ছা সত্যি করে বলেন তো আপনাকে কেউ কিছু বলেছে? আমাকে? না। কেন?–না আপনি প্রায়ই আসেন না কেন? আপনাকে কে কেউ থ্রেট করেছে। আমি তো অবাক! আমাকে কি বলবে? আমার সঙ্গে লাগতে আসবে কে? বলতে বলতে জাহাঙ্গীর নিজের হাতের মাসল ফুলিয়ে দ্যাখায়। বুলা গদগদ গলায় বলে, তারপর?
‘আমি বললাম, নাঃ আমাকে কে কি বলবে?—তা শাহীন বলে, না আপনি জানেন না, এরা আপনাকে হিংসা করে—আমাকে? কেন?— বোঝেন না? এই রাতদিন বকবক করা ছাড়া ওদের আছে কি? খালি প্যাচাল, খালি প্যাচাল। বড়ো-বড়ো কথা, খালি বড়বড় কথা। নিজেদের সব ইন্টারন্যাশনাল ফিগার মনে করে। আমিও বলে দিচ্ছি এখানে লাস্টিং করবেন শুধু আপনি, আর সব আউট হয়ে যাবে।–মানে? লাস্টিং করবো মানে? —বোঝেন না? দূর, আপনি না একেবারে একটা ইসে।
ইসে কি? ইয়ে বলল। বুলার এই ভাষাশুদ্ধির প্রচেষ্টা জাহাঙ্গীরের বাক্য-প্রবাহে এতোটুকু বিয়ের সৃষ্টি করতে পারে না, শাহীন বা শাহনাজ নামে মেয়েটির উক্তিকে সে বুলার কাছে প্রতিষ্ঠিত করে ছাড়বে, ঠিক বলেনি। বুলা ঠিক বলেনি? খালি চাপাবাজি করলে পুরুষমানুষ হইতে পারে?
আচ্ছা মেয়েটা ঐভাবেই বললো?
আরে বড়লোকের মেয়ে, ওদের কথাবার্তার ধরন অন্যরকম।
তুমি কি করলে? বুলা জানতে চায়, তবে জানা-জবাব শোনবার আগেই হাসতে শুরু করে।
আমি তো ঘাবড়াইয়া গেছি। বললাম, মাথাটা ধরছে, যাই। বলে, যাবেন মানে? ওষুধ দিচ্ছি, মাথা টিপে দিই। আমি কি আর থাকি? শাহীন ডাকে, আরে দাঁড়ান, ড্রাইভারকে বলি, গাড়ি করে দিয়ে আসুক। গড়িগুঁড়ির গুলি মারি, স্লামালেকুম— খোদা হাফেজ কইয়া করাইয়া একেবারে ছয়নম্বর বাস ধরছি, জিন্দেগিতে আর বনানী যাই নাই।