শুনে বুকটা তোলপাড় করে উঠল মাধবির। সে খুবই নরম মনের মেয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ভগবান নিশ্চয় এর বিচার করবে।
ঠিক তখুনি দুম দুম করে শব্দ হলো দরজায়। বাপ মেয়ে দুজনেই চমকাল।
জলধর বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, কে?
বাইরে থেকে শব্দ এলো। আমি। আমি ডাক্তার কাকা?
তুমি কে?
আমি বাদল। দরজা খোলেন।
গলাটা খুবই চেনা চেনা। তবু দরজা খুললেন না জলধর। বললেন, কোন বাদল?
মির্জা সাহেবের ছেলে।
সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হলেন জলধর। মোটা শরীর নিয়ে প্রায় ছুটে গিয়ে দরজা খুললেন। হাসিমুখে বললেন, তোর গলা আমি চিনতে পারিনি বাবা। কার শরীর খারাপ হলো?
বাদলের হাতে একটা টর্চ। সঙ্গে গ্রামের আরও তিন যুবক। আলমগির সুজন এবং মন্টু। দরজা খোলার পর ঘরের ভেতর থেকে ছিটকে আসা আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না সবার মুখ।
জলধরের কথা শুনে বাদল হাসিমুখে বলল, কারও শরীর খারাপ হয়নি কাকা।
তাহলে?
অন্য একটা কাজে এসেছি।
আয় ঘরে এসে বস।
না কাকা।
কেন? বসে বল।
তারপর মাথা নীচু করল বাদল। আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কি কাকা, আপনি তো জানেনই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। আমরাও আমাদের গ্রামে, স্কুলের মাঠে ট্রেনিং শুরু করেছি।
তা আমি জানি।
এ ব্যাপারে আমাদেরকে একটু সাহায্য করতে হবে যে!
কী সাহায্য বল?
গ্রামে যার যার বন্দুক আছে ….।
বাদলের কথা শেষ হওয়ার আগেই জলধর বললেন, বন্দুক লাগবে?
জ্বী কাকা?
আমারটা নিয়ে যা। গুলিও আছে অনেক। সেগুলোও নিয়ে যা। তোদের মতো যুবকরাই এখন আমাদের ভরসা। যেমন করে পারিস দেশটাকে বাঁচা।
তারপর মাধবির দিকে তাকালেন জলধর ডাক্তার। মাগো, বন্দুকটা ওদেরকে দিয়ে দে।
বিছানা থেকে নেমে আলমারি খুলল মাধবি।
.
০৭.
সকালবেলা মির্জা সাহেবের কাছারি ঘরে আজকাল বেশ একটা আড্ডা হয়।
আজও হচ্ছে।
গ্রামের বেশ কয়েকজন লোক এসে বসেছে। এই মাত্র ভেতর বাড়ি থেকে চায়ের ট্রে হাতে নবু এল কাছারি ঘরে। ট্রেতে অনেকগুলো চায়ের কাপ।
চায়ে চুমুক দিয়ে তালেব বলল, মির্জা সাহেব, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনেন না?
মির্জা সাহেব তালেবের দিকে তাকালেন। আমি শুনি সবই।
জলিল বলল, কিন্তু এইসব কইরা কিছু হইব না।
মোতালেব বলল, হবে না কেন?
সোনামিয়া হাসল। আপনে জানেন না মাস্টার সাব? জলিল তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায় না।
তালেব বলল, হ। জলিল হইতাছে পকিস্তানের পক্ষের লোক।
মির্জা সাহেব বললেন, যার যে পক্ষ ইচ্ছা সেই পক্ষে থাকবে।
মোতালেব বলল, তবে দুদিন আগে আর পরে, দেশ স্বাধীন হবেই।
সোনামিয়া বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ। এই জাতিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।
কথাটা শুনে জলিল একেবারে তেড়ে উঠল। আরে রাখেন মিয়া। দাবায়া রাখা যাইব না! পাকিস্তান আর্মি হইতাছে দুনিয়ার সেরা আর্মি। তাগ লগে যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন করব এসব দুধের পোলাপান? পাগল হইছেন আপনে?
মোতালেব কথা বলবার আগেই মির্জা সাহেব বললেন, কী যে হবে কিছুই বলা যায় না। কুষ্টিয়ার ওদিকে মুজিবনগর হয়েছে। অস্থায়ী
বাংলাদেশ সরকার গঠন হয়েছে। ওপারে গিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে ছেলেরা।
জলিল বলল, ওইপারে ক্যান, এই পারেও তো ট্রেনিং নিতাছে। আপনের ছেলে বাদল স্কুলের মাঠে বাংলাদেশের নিশান লাগাইছে। ইপিআরের এনামুল, আরে ওই যে লেংড়া এনামুল, সে পোলাপানগ ট্রেনিং দেওয়াইতাছে।
তালেব বলল, আপনের বন্দুকটা দিয়া দিছেননি মির্জা সাব?
না, ওরা এখনও আমারটা চায়নি।
জলিল বলল, চাইলেও দিবেন না।
মোতালেব বলল, কেন?
চোখ পাকিয়ে মোতালেবের দিকে তাকাল জলিল। সেইটা আপনেরে কমু না। যারে কওনের তারেই কইতাছি। তার লগে আপনেও শোনেন।
তারপর মির্জা সাহেবের দিকে তাকাল জলিল। বাদলরে আপনে মানা করেন। এইসব ঠিক হইতাছে না। থানায় থানায় মেলিটারি আসতাছে। যদি তারা খবর পায় বনসীমান্ত গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং হইতাছে তাইলে কিন্তু যখন তখন আইসা গ্রাম জ্বালাইয়া দিব। যারে পাইব তারেই গুলি কইরা মারব।
মির্জা সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, কথা ঠিক।
তালেব বলল, আপনে তাইলে …….।
তালেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত তুলে তাকে থামাল জলিল। তুই রাখ, আমি কই। মির্জা সাহেব বনসীমান্ত বাঁচাইতে চাইলে বাদলরে আপনে ফিরান।
জলিলের কথা শুনে মির্জা সাহেব চিন্তিত হয়ে গেলেন।
.
০৮.
স্কুল মাঠে পত পত করে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
তার তলায় ক্রাচ হাতে দাঁড়িয়ে আছে এনামুল। অদূরে সবুজ ঘাসের ওপর বন্দুক হাতে ক্রলিং করছে বাদল আলমগির মন্টু সুজন। চারজনের পরনেই প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। গরমে ঘামে শরীর ভিজে জবজব করছে। তবু মুখে কঠিন কঠোর প্রত্যয় যেন প্রত্যেকের।
ঘণ্টাখানেক পর ট্রেনিং শেষ করে এনামুলের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা।
এনামুল বলল, তোমরা পারবে।
বাদল বলল, পারতে আমাদেরকে হবেই।
কিন্তু তোমাকে আমার অন্য একটা কথা বলার আছে।
বলুন।
গ্রামে যে এখনও একটা বন্দুক রয়ে গেছে সেটা জোগাড় করনি কেন?
বাদল মাথা নীচু করল। বাবার বন্দুকটার কথা বলছেন?
হ্যাঁ।
এখনও বাবারটা আমি চাইনি।
কেন?
তেমন কোনও কারণ নেই।
কিন্তু প্রথমেই তো তারটা নেয়া উচিত ছিল।
আলমগির বলল, আসলে বাদল ওর বাবাকে খুব ভয় পায়।
সুজন বলল, বাবার সঙ্গে সরাসরি সেভাবে কথাই বলে না বাদল।