মনজু সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল। ভুল বললি। তুই করে বলতে হয়।
তারপর আদেশের গলায় বলল, শোন, দুলাভাইর নামধাম অফিস ইত্যাদি সব লিখে দে তো। চট করে একটা সারপ্রাইজ দিয়ে আসব।
দিচ্ছি।
সঙ্গে তোদের এই বাড়ির টেলিফোন নাম্বারটাও দিবি। যখন তখন ফোন করব।
কথাটা শুনে হাসিমুখ ম্লান হয়ে গেল সুমির। ফোন নাম্বারটা দিতে পারছি না।
কেন?
ফোনটা আর আমাদের নেই।
মানে?
ফোনটা আমরা বিক্রি করে ফেলেছি। দুতিন দিনের মধ্যে ট্রান্সফার হয়ে যাবে।
মনজু একটু থতমত খেল। তারপর সামান্য সময় কিছু ভেবে বলল, ঠিক আছে। দুলাভাইর অফিসের এডড্রেস দে।
সুমি এডড্রেস লিখে দিল।
.
১২.
খুবই একাগ্রতা নিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে সেলিম। কী একটা জটিল হিসেব বের করার চেষ্টা করছে।
এ সময় তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল মনজু। খুবই উফুল্ল গলায় বলল, স্লামালেকুম দুলাভাই। ভাল আছেন?
চমকে মনজুর মুখের দিকে তাকাল সেলিম। তারপর ঠোঁট টিপে হেসে নির্বিকার গলায় বলল, ওয়ালাইকুম সালাম। জ্বী ভাল আছি। বসুন।
সেলিমের এরকম নির্বিকার ভাব দেখে মনজু অবাক হলো। আপনার সমস্যাটা কী?
কিসের সমস্যা?
আমার সাইজের একটা লোক দুলাভাই দুলাভাই করছে আর আপনি একটুও অবাক হচ্ছেন না!
কম্পিউটার অফ করে হাসল সেলিম। আপনি বোঝেননি কেন অবাক হচ্ছি না?
না।
সুমি আমাকে সব বলেছে।
ও এই কথা। আচ্ছা মুরগির কলিজা গিলা দেয়া সিঙারা কোথায় পাওয়া যাবে বলুন তো?
তারপরই নিজেকে সামলালো মনজু। থাক, লাঞ্চ আওয়ার হয়ে গেছে। চলুন হাজির বিরিয়ানী খেয়ে আসি।
বলেই নির্মল মুখ করে হাসল। বিরক্ত হচ্ছেন না তো? আসলে আমার যাকে ভাল লাগে আমি তার সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।
আমার সঙ্গেও মিশবেন। কোনও অসুবিধা নেই।
আপনাকে আমার খুব ভাল লাগল।
ধন্যবাদ।
এরপর একটা এবং আছে।
কী?
আপনার কাছে আমি একটা হেলপ চাইব।
কী ধরনের?
চলুন বিরিয়ানী খেতে খেতে বলব।
সেলিম উঠল। তবে আমার একটা কথা আছে।
বলুন।
বিরিয়ানীর বিলটা আমি দেব।
তা তো দেবেনই। দুলাভাই সঙ্গে থাকলে শ্যালকরা কি কখনও বিল দেয়?
না তা দেয় না।
তাহলে?
অবশ্য বাঙালি সভ্যতায় এই প্রথম একটা অভিনব ব্যাপার ঘটছে।
কী বলুন তো?
হবু স্ত্রীর বড়ভাইও শ্যালক সেজেছে। হওয়া উচিত সমুন্দি।
মনজু হাসল। না আমি আপনার শ্যালক হয়েই থাকতে চাই।
বিরিয়ানী খেতে খেতে মনজু যা বলল শুনে চোখ স্থির হয়ে গেল সেলিমের। কোনও রকমে সে বলল, আপনি এসব কেন করতে চাচ্ছেন?
মনজু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি মনে করছি এটা আমার কর্তব্য।
কর্তব্য মনে করবেন কেন? ওরা তো আসলে আপনার কেউ না।
এক অর্থে কেউ না, আরেক অর্থে খুব আপন। সেই যুদ্ধের দিনে মাসুদ চাচা না বাচালে আমার বাবা বেঁচে থাকতেন না, আমার এই পৃথিবীতে আসা হতো না। আপনাদের মতো কতো ভাল মানুষ চারদিকে, এইসব মানুষের সঙ্গে দেখা হতো না।
কিন্তু আমি এসব সামাল দেব কেমন করে?
সামাল দেয়াটা আপনার পক্ষেই সব চাইতে সহজ। আপনাকে শুধু। বলতে হবে আপনি সব করছেন।
কেউ বিশ্বাস করবে না।
কেন?
আমিই যদি সব করব এতদিন করিনি কেন?
এসবের কোনও একটা অজুহাত বের করবেন।
বলেই সেলিমের একটা হাত ধরল মনজু। আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে যিনি বাঁচিয়েছিলেন সেই মহান মুক্তিযোদ্ধার পরিবারটিকে বাঁচাতে আপনি আমাকে সাহায্য করুন।
সেলিম অপলক চোখে মনজুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
.
১৩.
পারু চিন্তিত গলায় বললেন, তুমি এতকিছু সামাল দেবে কেমন করে?
সন্ধের পর সুমিদের বাড়ি এসেছে সেলিম। অফিস থেকে সরাসরিই এসেছে। এসেই কিছু কথা বলেছে। শুনে পারু ওই কথা বললেন।
পারুর কথা শুনে সেলিম বলল, আমি সামাল দিতে পারব।
কীভাবে?
ব্যবস্থা আছে।
কী ব্যবস্থা?
শেষ কথাটা বলল সুমি। সে দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনে।
সেলিম সুমির দিকে তাকাল। তোমাদের ফ্যামিলির অবস্থা দেখে এসব নিয়ে অফিসে কথা বলেছিলাম আমি।
কবে?
বেশ কয়েকদিন আগে।
তারপর?
বলেছিলাম লাখসাতেক টাকা হলে সব মিটে যায়। মকবুল সাহেবের টাকা শোধ করা যায়, বিয়ের খরচ, তোমার চাকরি বাকরি না হওয়া পর্যন্ত সংসার খরচ।
সাত লাখ টাকার কথা শুনে পারু একেবারে আঁতকে উঠলেন। সাত লাখ টাকা কি মুখের কথা?
সেলিম বলল, কিন্তু টাকাটা আমি এরেঞ্জ করেছি।
সুমি বলল, কীভাবে?
অফিস আমাকে লোন দেবে।
পারু বললেন, এত টাকা লোন দেবে?
জ্বী দেবে।
টাকা তুমি শোধ করবে কেমন করে?
মাসে মাসে বেতন থেকে কেটে নেবে।
সুমি কী রকম চিন্তিত চোখে সেলিমের দিকে তাকিয়ে রইল।
পারু বললেন, না না। আমাদের জন্য এত বড় ঝামেলায় জড়াবার। দরকার নেই তোমার। তারচে বাড়ি চলে যাক। তাছাড়া তোমাদের বাড়িতে ব্যাপারটা জানাজানি হলে ….।
সেলিম দৃঢ় গলায় বলল, কেউ জানবে না। এসব নিয়ে আপনি ভাববেন না।
তারপর সুমির দিকে তাকাল সেলিম। সুমি, টেলিফোনটা যারা কিনতে চেয়েছে তাদেরকে মানা করে দিও। আর মকবুল সাহেবের ফোন নাম্বারটা দাও।
সুমি তখনও আগের মতো চোখ করে সেলিমের দিকে তাকিয়ে আছে।
.
১৪.
দুদিন পর সকালবেলা মকবুল সাহেবের অফিসে এসে ঢুকল মনজু এবং সেলিম।
মকবুল সাহেব ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
সেলিম বলল, আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম।
মকবুল সাহেব ব্যস্ত হলেন। ও আচ্ছা। বসুন, বসুন।