ব্যাপারটা যে এত গুরুতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেটা হাবুলের একদম ভাল লাগছিল না।
আজ পড়ায় হাবুলের মন নেই। বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর অসহ্য লাগায় সে উঠে পড়ল। তারপর সোজা গিয়ে
ছেলেটার ঘরে হানা দিল।
ছেলেটা ফিরেছে, এবং একটা মাপবার ফিতে দিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে জানালা থেকে খাট অবধি কী সব মাপজোখ করছে।
হাবুল বলল, “কী করছেন?”
ছেলেটা তার দিকে চেয়ে ভারী সুন্দর করে হেসে বলল, “রাতের অতিথিদের জন্য তৈরি থাকছি।”
“রাতের অতিথি মানে কি চোর? আমাদের বাড়িতে চোর আসে না। টমি আছে। তা ছাড়া দাদুকে এখানে সবাই খাতির করে আর ভয় পায়।”
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, “আমি যদি চোর হতাম তবে এসব বাধা আমার কাছে বাধাই হত না।”
হাবুল বিরক্ত হয়ে বলল, “কিন্তু আপনি তো আর চোর নন। এখানকার চোরেরা আমাদের বাড়ি ঢুকবেই না।”
ছেলেটা মৃদু হেসে বলল, “আজ ঢুকতে পারে। এতদিন আসেনি বলেই কি আজ আসবে না? এসো, ভিতরে এসে বোসো। আলাপ করি।”
হাবুল সসঙ্কোচে ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বসল। ঘরটা বেশ ঝকঝক করছে এখন।
ছেলেটা বিছানায় তার মুখোমুখি হয়ে বসে বলল, “তোমার নাম যে হাবুল তা জানি। আমার নাম হল গন্ধর্বকুমার। বিচ্ছিরি নাম, না?”
হাবুল হেসে বলল, “একটু পুরনো, কিন্তু বেশ ভারিক্কি।”
“আমাদের পরিবারে ভারিক্কি নাম রাখাটাই চল। তুমি আমাকে গেনুদা বলে ডেকো। আমার ডাকনাম গেনু। গন্ধর্বেরই সংক্ষিপ্ত সংস্করণ।”
ছেলেটাকে হাবুলের বেশ লাগছে। হাসিখুশি, আমুদে, উজ্জ্বল। তবু যে একে কেন দাদুর এত ভয়!
হাবুল বলল, “আচ্ছা, আমার দাদুর সঙ্গে আপনার কিসের সম্পর্ক বলুন তো!”
“আপনি নয়, তুমি। আমাকে তুমি’ বলে ডাকলে খুশি হব।”
“ঠিক আছে। এবার জবাবটা দাও।” গন্ধর্ব একটু অন্যমনস্ক হয়ে জানালার দিকে চেয়ে রইল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “সত্যি বলতে কি, তোমার দাদু যদি নিজে থেকে কিছু না বলেন, তা হলে আমারও জানার সাধ্য নেই তার সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক বা আমাকে দেখে তিনি এত ঘাবড়েই বা গেছেন কেন।”
“আপনি নিজে কিছু জানেন না?”
গন্ধর্ব মাথা নেড়ে বলল, “তেমন বিশেষ কিছু নয়। তবে এটুকু জানি যে, সঁওতাল পরগনায় আমাদের কিছু জমিজমা ছিল, আর ছিল মস্ত এক কারবার। এখন আর কিছুই নেই। আমি কপর্দকশূন্য। আমার কিছু শত্রুও আছে। সেইসব নানা কারণেই আমাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। শুধু দাদুর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। তারপরই বেরিয়ে পড়ি।”
“তোমার দাদু কি আমার দাদুর বন্ধু?”
“তা তোমার দাদুই বলতে পারবেন। আমি কিছুই জানি না। তবে আমার দাদু মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলে গিয়েছিলেন যেন অবশ্যই রতন বাড়ুজ্যের সঙ্গে দেখা করি। সেইজন্যই আসা।”
“তোমার বাড়িতে আর কে আছে?”
গন্ধর্ব মাথা নেড়ে মলিন একটু হাসল। তারপর বলল, “কেউ নেই। বছর দশেক আগে আমাদের বাড়িতে একদল লোক চড়াও হয়ে সবাইকে মেরে ফেলে। শুধু দাদু কোনওক্রমে আমাকে নিয়ে পালিয়ে বেঁচে যান। তারপর থেকে আমি আর দাদু কেবল জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরেছি, গা-গঞ্জে মজুর খেটেছি, ভিক্ষে করেছি। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না।”
“কেন, উপায় ছিল না কেন?”
“কিছু লোক আমাদের ভয়ঙ্কর শত্রু। তারা এখনও সেখানে অপেক্ষা করে আছে। ফিরে গেলেই তাদের হাতে মরতে হবে। আমি দাদুকে প্রায়ই বলতাম, চলো দাদু, অন্য কোথাও গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করি। কিন্তু দাদু সে কথায় আমল দিতেন না। দাদুর খুব ইচ্ছে ছিল নিজেদের বিষয়সম্পত্তি আবার উদ্ধার করবে। কিন্তু সেটা বোধহয় আর সম্ভব নয়।”
গন্ধর্বের কথা শুনে হাবুলের খুব কষ্ট হচ্ছিল। চোখ ছলছল করছিল তার। সে বলল, “তুমি খুব কষ্ট করেছ গেনুদা।”
“কষ্ট বলে কষ্ট! সাঙ্ঘাতিক কষ্ট। প্রত্যেকটা দিনই ছিল বেঁচে থাকার লড়াই। তবে সে-জীবনেরও একটা আনন্দ আছে। শিকার করে বা বনের ফলপাকুড় পেড়ে আমাদের খাওয়া চলত। গাছের ডালে বা মাটিতে শুয়ে কত রাত কেটে গেছে। সে-জীবন কীরকম তা তুমি ভাবতেও পারবে না। ভিক্ষে করতে যখন লোকালয়ে আসতাম তখন কষ্ট হত সবচেয়ে বেশি। আমাদের একসময়ে রাজার মতো সম্মান ছিল। তাই হাত পাততে ভীষণ লজ্জা করত। কিন্তু বেঁচে থাকতে গেলে তো সবই করতে হয়। আবার এরকম কষ্ট করে করে আমি শিখেছিও অনেক।”
হাবুল সম্মোহিতের মতো একদৃষ্টে গন্ধর্বের মুখের দিকে চেয়ে ছিল। কী সুন্দর মুখ, কী সরল চোখের দৃষ্টি। এই লোকটাকে দাদু কেন ভয় পাচ্ছে তা কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছিল না। ভয় নয়, গন্ধর্বকে দেখে মায়া হওয়াই তো স্বাভাবিক।
গন্ধর্ব অন্যমনস্কের মতো জানালার বাইরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে ছিল।
হাবুলের গলা ধরে আসছিল, অস্ফুট গলায় বলল, “আমাদের কাছে থাকো না গেনুদা! তোমার কোনও কষ্ট থাকবে না। আমার তো দাদা নেই, তোমাকে দাদা বলে ডাকব।”
গন্ধর্ব একটু অবাক হয়ে হাবুলের দিকে চাইল, তারপর সুন্দর করে হেসে বলল, “আমাকে তো তুমি ভাল করে চেনোও না এখনও।”
হাবুল জোরের গলায় বলল, “আমি জানি তুমি ভাল ছেলে।”
গন্ধর্ব মাথা নেড়ে বলল, “আমার তো কেউ নেই, তাই তোমাদের মতো একটা পরিবারে নিজের জনের মতো থাকতে পারলে ভালই হত। কিন্তু তা হওয়ার নয়।”
“কেন নয় গেনুদা?”
“আমার অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে। পরে শুনবে।” হাবুল উঠল। বলল, “আমি পড়তে যাচ্ছি। কাল তোমার গল্প শুনব।”