- বইয়ের নামঃ অসুখের পরে
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. রহস্যময় গোপন শিহরন
০১.
বাতাসে আজ কিছু মিশে আছে। রহস্যময় গোপন কোনও শিহরন? কোনও আনন্দের খবর? কোনও সুগন্ধ? কোনও মধুর অশ্রুত শব্দের কম্পন? হেমন্তের সকালে ভিতরের বারান্দায় টিয়া পাখি অস্ফুট কিছু কথা বলতে চাইছে। ভোরের আলোটিতে আজ কিছু গাঢ় হলুদের কাঁচা রং।
শিয়রের মস্ত জানালার খড়খড়ির একটি পাটি ভাঙা। পুবের তেরছা রোদ একফালি এসে পড়ে আছে মেঝেয়, যে মেঝে প্রায় একশো বছরের পুরনো। মস্ত উঁচু সিলিঙে খেলা করছে রোদের আভা। বিমের খাঁজে চতুর পায়ে ঘুরছে ফিরছে বন্দনার পোষা পায়রারা।
বন্দনার আজ আর অসুখ নেই। তিন দিন হল জ্বর ছেড়ে গেছে। শরীরটা ঠাণ্ডা, বড় বেশি ঠাণ্ডা হয়ে আছে তার। একটুও জোর নেই গায়ে। তবু এমন ভাল দিনটা কি বয়ে যেতে দেওয়া যায়?
তাদের ঘরগুলো বড্ড বড় বড়। কী বিরাট তার পালঙ্কখানা! কত উঁচু। এই পালঙ্কে তার দাদু শুত, তারও আগে হয়তো শুত দাদুরও দাদু। এই পালঙ্কেরও কত যে বয়স! এতকালের জিনিস, তবু পাথরের মতো নিরেট। বন্দনা উঠে বসল। পালঙ্কের অন্য পাশে মা ছিল শুয়ে। ভোরবেলা উঠে গেছে। এ সময়ে মা ঠাকুরঘরের কাজ সারে। তারপর রান্নাঘরে যায়।
বসে বন্দনা আগে তার এলোমেলো চুল দুর্বল হাত দুটি দিয়ে ধরল মুঠো করে। তার অনেক চুল। চুলের ভারে মাথাটা যেন টলমল করে। যেমন ঘেঁস তেমনি লম্বা। খোঁপা বাঁধলে মস্ত খোঁপা। হয় তার।
একটু কষ্ট করেই এলো খোঁপায় চুলগুলোকে সামাল দিল সে। তারপর নামবার চেষ্টা করল। পালঙ্ক থেকে নামা খুব সহজ নয়, বিশেষ করে দুর্বল শরীরে। পালটা বড্ড উঁচু বলে নামা-ওঠার। জন্য একটা জলচৌকি থাকে। বন্দনা সেটা দেখতে পেল না। বোধহয় অন্য ধারে রয়েছে। পালটা পার হয়ে ওপাশ দিয়ে নামবে কি না একটু ভাবল বন্দনা। এই পালঙ্ক তার ছেলেবেলার সাথী। রেলিং বেয়ে, ছত্রি বেয়ে কত খেলা করেছে। আজ কি পারবে না একটু লাফ দিয়ে নামতে? দুর্বল হাঁটু কি বইতে পারবে তাকে। গত পনেরো দিন সে বিছানা থেকে খুব কমই। নেমেছে। বিছানায় বেডপ্যান, বিছানায় স্পঞ্জ, বিছানাতেই খাওয়া। বিছানা তাকে খেয়ে ফেলেছিল একেবারে।
আস্তে তার ফর্সা ডান পাখানা মেঝের দিকে বাড়িয়ে দিল বন্দনা। পাখানা শুন্যে দুলছে। মেঝে নাগালের অনেক বাইরে। দুর্বল হাতে খাটের বাজু চেপে ধরে খুব সাবধানে কোমর অবধি ঝুলিয়ে দিল বন্দনা। তারপর ঝুপ করে নামল। টলোমলো দুটি পা তাকে ধরে রাখতে পারছিল না। প্রায়। খাটে ভর দিয়ে সে যখন দাঁড়াল তখন মুখে একটা হাসি ফুটল তার।
বন্দনার পরনে একখানা ভারী কাপড়ের নাইটি। গুটিয়ে গিয়েছিল, ঠিকঠাক করে নিল বন্দনা। মেঝে থেকে পাথুরে শীতলতা শরীর বেয়ে উঠে আসছে। একটু শীত করছে তার। শিয়রের কাছে ভাঁজ করা টমেটো রঙের পশমের চাদর রাখা আছে। বন্দনা সেটা গায়ে জড়িয়ে নিল।
তার চেহারা কি খুব খারাপ হয়ে গেছে? উত্তর দিকে মেঝে থেকে প্রায় সিলিং অবধি বিশাল মেহগনি কাঠের আলমারির গায়ে খুব বিরাট আয়না লাগানো। আয়নার পারা কিছু উঠে গেছে। তার সামনে এসে দাঁড়াল বন্দনা। নিজেকে তার একটুও পছন্দ হল না দেখে।
বিবর্ণ রক্তহীন পাঁশুটে মুখ। বরাবরই সে একটু রোগা। এখন কঙ্কালসার হয়েছে তার শরীর। গলাটা কত সরু হয়ে গেছে আরও। ঝ্যালঝ্যাল করছে গায়ের পোশাক।
বন্দনা তার দুটি হাওয়াই চটি পরে নিল। ধীর পায়ে সে এসে দাঁড়াল ভিতরের বারান্দায়। তাদের পুরনো আমলের বাড়ির সবকিছুই বড় বড়। এই বারান্দায় একসময়ে দুশো লোক পংক্তিভোজনে বসত। আজকাল পংক্তিভোজন হয় না। বারান্দার সামনের দিকে ওপর থেকে অনেকটা জুড়ে কাঠের আবডাল, তার নীচে রঙিন কাঁচ। বুক সমান লোহার মজবুত রেলিং। বারান্দায় কয়েকটা খাঁচা দুলছে। আগে অনেকগুলো খাঁচা ছিল। আজকাল নেই। মোট চারটে খাঁচার মধ্যে দুটিতে দুটি পাখি আছে। একটায় টিয়া, অন্যটায় একটা বুলবুলি। আর দুটো খাঁচা উত্তরের শিরশিরে হাওয়ায় দুলছে।
খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে টিয়াকে একটু দেখল বন্দনা। খাঁচার মধ্যে পাখি দেখতে তার ভাল লাগে না। বিলু পাখি পোষে। কিন্তু বিলু বড় হচ্ছে, এখন আর পাখির দিকে মন নেই তেমন। বিলু এখন ক্রিকেট খেলতে যায়, ফুটবল খেলতে যায় বিলুর এখন অনেক পড়াশোনার চাপ।
বুকসমান রেলিঙের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বন্দনা নীচের বাঁধানো উঠোনটা দেখল। ভাঙ শান, কোনও কচু গাছের ঝোপ, ঘাস, আগাছ। উঠোনের মাঝখানে বাঁধা তারে কয়েকটা কাপড় শুকোচ্ছে। উঠোনের ওপাশে কাছারি-ঘর। অবশ্য এখন আর নায়েব গোমস্তা কেউ নেই। ওখানে এখন মদনকাকা থাকে। কাছারি-ঘর ছাড়িয়ে একটা বাগানের মতো আছে। তারপর ভাঙা দেউড়ি।
এ বাড়ির মধ্যে এখনও একশো বছরের পুরনো বাতাস। এখনও তাদের হয়-ছয়া গুলোতে গুনগুন করে বেড়ায় কত ইতিহাস। দেয়ালে দেয়ালে এখনও সোনালি ধাতব ফ্রেমে বাঁধানো অয়েল পেন্টিং। তাদের পূর্বপুরুষেরা ছবির চোখ মেলে চিত্রার্পিত চেয়ে থাকে।
ঘুরে দাঁড়ালেই দেখা যাবে দেয়ালে আঠা দিয়ে সাঁটা লেনিনের একখানা ছবি। ধুলোটে ময়লা পড়েছে ছবিতে, বিবর্ণ হয়ে গেছে, তবু মা কখনও ওই ছবি খুলতে দেয়নি কাউকে। ছবিটা লাগিয়েছিল বন্দনার দাদা প্রদীপ। দাদা আর নেই।