- বইয়ের নামঃ হারানো কাকাতুয়া
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
০১-০৫. ঐ গবা পাগলা বেরিয়েছে
হারানো কাকাতুয়া – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
ঐ গবা পাগলা বেরিয়েছে। গায়ে একটা সবুজ রঙের আলপাকার কোট আর ভোলা কালো রঙের পাতলুন। বড়-বড় কটাশে চুল রোগাটে মাঝারি চেহারা। এক গাল দাড়ি, বিশাল মোচ। পায়ে খয়েরি রঙের ক্যামবিসের জুতো। হেঁকে বলছিল, “কেয়াসমাস! কেয়াসমাস! বর্বর ছেলেরা দৌড়িয়া ফেরে। সরল রেখা কাকে বলে? দুটি বিন্দুর মধ্যে ন্যূনতম দূরত্বই হচ্ছে সরলরেখা। এন এ সি এল ইজ সোডিয়াম ক্লোরাইড অ্যাণ্ড ইট ইজ কমন সলট। ভাস্কো ডা গামা ভারতবর্ষে আসে চোদ্দ শো আটানবৃই সালে………হেঁ হেঁ জানি বাবা, সব জানি।”
সকালবেলা হরিহরবাবু আর গদাধরবাবু বাজার করে ফিরছিলেন। গবা পাগলাকে দেখে হরিহরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “এঃ, আবার দেখি গবাটা উদয় হয়েছে! ছেলেপেলেগুলোর মাথা খাবে আবার!”
গদাধরবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “আপনার কথাটা মানতে পারছি না হরিহরবাবু। গবা পাগলা যে একজন ছদ্মবেশী বৈজ্ঞানিক এ কথা সবাই জানে।”
হরিহরবাবু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “হ্যাঁ, বৈজ্ঞানিকরা তো আজকাল গাছে ফলে কিনা! পেরেছে গবা পাগলা আপনার দেয়ালঘড়িটা সারাতে?”
গদাধরবাবু একটু গরম হয়ে বললেন, “পেরেছে বই কী! আলবাত পেরেছে।”
হরিহরবাবু হোহো করে হেসে বলেন, “তাই বুঝি আপনার দেয়ালঘড়ির কাটা উল্টোদিকে ঘোরে?”
“সেইটেই তো বিস্ময়! আর কার ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে ঘোরে বলুন তো? বৈজ্ঞানিক ছাড়া পারে কেউ ঘড়ির কাটাকে বিপরীতগামী করতে?”
এইভাবে হরিহরবাবু আর গদাধরবাবুর মধ্যে একটা তর্কবিতর্ক পাকিয়ে উঠছিল।
আগের দিন দুধের মধ্যে একটা কুঁচো চিংড়ি পেয়েছিলেন হালদারবাড়ির বুড়ি। তাই গয়লাকে বকছিলেন। গবা পাগলার সাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে একগাল হেসে বলেন, “বাব্বাঃ! কতদিন পরে গবাসাধু আবার এ পোড়া শহরে ফিরেছে! এবার আমার কাকালের ব্যথাটার একটা হিল্লে হবে।”
গুণধরবাবু তাঁর বাগানে নেতিয়ে পড়া একটা লাউডগাকে মাচানে তুলছিলেন। চশমার ফাঁক দিয়ে গবা পাগলাকে দেখে গিন্নিকে ডাক দিয়ে বললেন, “গবা চোরটা আবার এসেছে জিনিসপত্র সব সামলে রেখো। সেবার ও হাওয়া হওয়ার পর থেকেই আমাদের দু দুটো কাসার বাটি গায়েব হল।”
দুই ভাই–আন্দামান আর নিকোবর জানালার ধারে বসে অ্যানুয়্যাল পরীক্ষার পড়া তৈরী করছিল। আন্দামান অঙ্কে কঁচা, নিকোবর কঁচা ইংরেজীতে।
আন্দামান গবা পাগলাকে জানালা দিয়ে দেখেই চাপা গলায় বলল, “আগের বারের মতো এবারেও গবাদা ঠিক পরীক্ষার সময় বাইরে থেকে চেঁচিয়ে অঙ্ক বলে দেবে। বাঁচা গেল বাবা, অঙ্ক নিয়ে যা ভাবনা ছিল!”
নিকোবরও চাপা গলায় বলল, “আমার কুড়ি নম্বরের ট্রানস্লেশনের ব্যবস্থাও হয়ে গেল।”
বোধনের সকালের পড়া হয়ে গেছে। এবার নেয়ে-খেয়ে স্কুলে যাবে। হাতে খানিকটা সময় আছে দেখে সে তার মহাকাশযানে কিছু যন্ত্রপাতি লাগাচ্ছিল। তার মহাকাশটানটা দেখলে যে-কেউ অবশ্য নাক সিঁটকাবে। কারণ সেটা আসলে একটা ফুলঝাটা। ঝাটার হাতলের সঙ্গে গোটা চারেক হাউই দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। ঝাটার সঙ্গে একটা কৌটোও বাঁধা আছে। তার ইচ্ছে ঐ কৌটোয় কয়েকটা পিঁপড়ে ছেড়ে দেবে। আজ সে মহাকাশযানের সঙ্গে মেজোকাকার সাধের পকেট-ট্রানজিসটার রেডিওটা চুপি-চুপি লাগিয়ে দিচ্ছিল। এমন সময় রাস্তায় গবা পাগলার হাঁকডাক শোনা গেল : “দেখবি যদি ভুতের নাচ, ধর বাগিয়ে বঁটাগাছ, ডিং মেরে ওঠ গাধার পিঠে।নখুড়োর ঘর পেরিয়ে ঈশানকোণে যা হারিয়ে, লাগবে হাওয়া মিঠে। দেখতে পাবি তিনঠেঙে গাছ, তাহার ডালে ঝুলতেছে মাছ নীচে গহিন ছায়া। সেই ছায়ারই কায়া ধরে ভুত-ভুতুড়ে অদ্ভুতুড়ে নাচতেছে সব মায়া……..”
বোধন দৌড়ে রাস্তার ধারে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে, “ও গবাদা! মঙ্গলগ্রহ থেকে জ্যান্ত পাথর এনে দেবে বলেছিলে যে! সেইসব পাথর নাকি আপনা থেকেই গড়িয়ে-গড়িয়ে চলে ছোট থেকে বড় হয়, রেগে গেলে একটা গিয়ে আর-একটাকে ছুঁ মারে!”
হেঃ হেঃ করে হেসে গবা পাগলা বলে, “চার দুগুনে আট এ তো সবাই জানে। কিন্তু বলো তো বাছাধন, হ্যারিকেনকে পেনসিল দিয়ে গুণ করলে কত হয়?”
থানার দারোগা কুকুসুমের নামটা যত নরম, মানুষটা ততই শক্ত। ছ ফুট লম্বা দশাসই চেহারা। গলার স্বরে স্পষ্ট বাঘের ডাক। রোজ আড়াইশো করে বুকডন আর বৈঠক মারেন। রাগলে ভিসুভিয়াস। বাস্তবিকই নাকি রাগন্ত অবস্থায় তার মাথার চারপাশে একটা লালচে মতো আভা অনেকে দেখেছে। কুকুসুমের ভয়ে এই অঞ্চলের গুণ্ডা বদমাস চোর বাটপাড় সব রোগা হয়ে যাচ্ছে, ভাল করে খেতে পারে না, ঘুমোতে পায় না, ঘুমোলেও দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে যায়। সকালবেলায় কুন্দকুসুম সবে থানায় এস কোমরের বেল্টটা খুলে রেখে গায়ে একটু হাওয়া লাগাচ্ছেন, এমন সময় রাস্তায় গবার চেঁচানি শোনা গেল, “সবাই জানে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। কিন্তু বুদ্ধি পালালে কী বাড়ে? অ্যাঁ?”
কুলকুসুম সিধে হয়ে বসে বললেন, “স্পাইটা আবার এসেছে। ওরে, নজর রাখিস। নজর রাখিস!”