মেছোবাজারের কাছে কে যেন পিছন থেকে ডাকল, “ওরে ষষ্ঠী! কোথায় চললি অমন মেট্রেনের মতো?”
ষষ্ঠী ফিরে দেখল, টিকে গুণ্ডা। দশাসই চেহারা। পরনে লুঙ্গি, গায়ে ফিনফিনে স্যাণ্ডো গেঞ্জি, ইয়া গোফ, বাবরি চুল, গলায় সোনার চেন-ও একখানা ধুকধুকি ঝুলছে। টিকে গুণ্ডা খুবই তালেবর লোক ছিল একসময়ে। বাজারে তার মাংসের দোকান। তবে এখন আর তো দাপট নেই। শোনা যায় যে, টিকে গুণ্ডা টাকা নিয়ে খুন-টুন করে।
তাকে দেখে ষষ্ঠীর মাথায় চড়াক করে বুদ্ধি খেলে গেল। ছোরাটাকে জব্দ করতে হলে টিকে গুণ্ডার চেয়ে উপযুক্ত লোক আর কে আছে?
ষষ্ঠী খুব কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “টিকো, খুব ঠেকায় পড়ে গেছি। একটু উদ্ধার করে দিতে পারবে?”
টিকে সন্দিহান চোখে চেয়ে বলল, “টাকা ধার চাইবি নাকি? ওসব হবে না।”
ষষ্ঠী বুক ফুলিয়ে বলল, “আরে না না। ধার চাইব কেন, বরং তোমাকে কিছু পাইয়ে দেবখন। তবে কাজের পর।”
টিকে চোখ দুটো ছোট করে বলল, “তুই কাজ করিয়ে আমাকে টাকা দিবি? বলিস কী রে? লটারি পেয়েছিস নাকি? না মাথাটা বিগড়েছে?”
ষষ্ঠী গম্ভীর হয়ে বলল, “মাথাও বিগড়োয়নি, লটারিও পাইনি। তবে একটা ব্যাপার ঘটেছে। একটা তে-এটে ছোঁকরাকে সাফ করে দিতে হবে।”
টিকে চোখ আরও ছোট করে বলল, “বটে! তুই আমাকে টাকা খাইয়ে খুন করাতে চাস? বাঃ, তোর এলেম তো দিব্যি বেড়েছে রে ষষ্ঠী! তা ছেলেটা কে?”
“যদি রাজি থাকো তো বলো। বেশি বকবক কোরো না।”
টিকে অনেকক্ষণ ঠাণ্ডা চোখে ষষ্ঠীকে দেখে নিয়ে বলল, “কত টাকা দিবি শুনি!”
“দু’পাঁচশো যা হোক দেব। তুমি ঠকবে না।”
টিকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ঠিক আছে, না হয় রাজিই হলুম, এবার বল তো ছোঁকরাটা কে আর তাকে খুনই বা করতে চাইছিস কেন?”
ষষ্ঠী একটু সাবধান হল। আসল বৃত্তান্ত জানতে পারলে টিকে নিজেই লাখ টাকার আংটিটা গাপ করবে। তাই সে গলা-খাকারি দিয়ে বলল, “দ্যাখো বাপু, অত খতেন নিলে কাজ তোমাকে করতে হবে না। যদি রাজি থাকো তো রাত বারোটার পর আমবাগানের ঈশেন কোণে হাজির থেকো। আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব।”
“কোথায় নিয়ে যাবি?”
“একটা বাড়িতে। তবে কার বাড়ি তা এখন বলব না।”
“তারপর কী হবে?”
ষষ্ঠী মাথা চুলকে বলল, “তারপর কাজ খুব কঠিন নয়। বাইরে থেকে দরজা খুলে দুজনে ভিতরে ঢুকব। যাকে খুন করতে হবে, তাকেও আগে থেকে ঘুম পাড়িয়ে দেব। তোমাকে তেমন মেহনত করতে হবে না।”
টিকে মাথা নেড়ে বলল, “আমি তেমন কাপুরুষ খুনিয়া নই রে যে, ঘুমন্ত মানুষকে খুন করব। খুন করতে হয় তো বাপের ব্যাটার মতো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জলজ্যান্ত মানুষকেই করব।”
ষষ্ঠী তাড়াতাড়ি টিকের পথ আটকে পঁড়িয়ে বলে, “সে তো ভাল কথা, কিন্তু তোমারও বলতে নেই বয়স কম হল না। গায়ে তোমার সঁড়ের মতো জোর আছে তাও সত্যি, কিন্তু এ-ছোঁকরার বয়সও কম, তেজও আছে।”
টিকে গুম মেরে থেকে বলল, “খুনের পর কী হবে?”
ষষ্ঠী বলল, “ব্যস, তারপর তুমিও কেটে পড়বে, আমিও কেটে পড়ব।”
“তোর আর কোনও মতলব নেই?”
“না। সত্যি বলছি, মা কালীর দিব্যি।”
টিকে হঠাৎ তার বিশাল থাবায় কাক করে ষষ্ঠীর ঘাড় চেপে ধরে প্রায় শূন্যে তুলে ফেলে বলল, “পেট থেকে সত্যি কথাটা এইবেলা বের না করলে দুই ঝাঁকুনিতে তোর মগজের ঘিলু নাড়িয়ে দেব।”
ষষ্ঠী চিচি করে বলল, “বলছি বলছি। ছাড়ো…আঃ, দম আটকে যাবে যে!”
টিকে তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “এবার বল।”
ষষ্ঠী হাফাতে-হাফাতে বলল, “তার কাছে আমার একটা আংটি আছে। সেটা শুধু খুলে নেব আঙুল থেকে।”
টিকে খুব হাসল। তারপর ষষ্ঠীর পিঠে একটা বিরাশি সিক্কার চাপড় বসিয়ে বলল, “তোর মাথা আছে বটে। ঠিক আছে, থাকব আমবাগানের ঈশেন কোণে রাত বারোটায়। দেখা যাক তোর কেরামতি।”
০৫. ছেলেটা আসার পর থেকেই
ছেলেটা আসার পর থেকেই যে দাদুর মন খারাপ হয়ে গেছে, সেটা বুঝতে পেরে হাবুলের মনটাও ভাল নেই। বিকেলে ফুটবলের মাঠে সে আজ খুবই খারাপ খেলল। দু দুবার ওপেন নেট পেয়েও গোল করতে পারল না। ভুল পাস করল অজস্র। ড্রিবলিংও খুব খারাপ হল তার।
কোচ দয়ারাম দাস খেলার পর তাকে ডেকে বলল, “আর দু’দিন বাদে প্রভাবতী শিন্ডের সেমিফাইন্যাল। মন দিয়ে না খেললে ফাঁইন্যালে যাওয়ার আশা নেই। যবনপুর খুব শক্ত টিম।”
হাবুল মাথা নিচু করে রইল।
বাড়ি এসে হাতমুখ ধুয়ে ছেলেটার খোঁজ করে জানল, সে বেরিয়ে গেছে।
হাবুল গিয়ে দাদুর কাছে দাঁড়াল। “দাদু, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
দাদু মধু আর সর দিয়ে মারা স্বর্ণসিন্দুর খাচ্ছিলেন। মুখ তুলে বললেন, “বলো।”
“ছেলেটা কে?” দাদু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “নিয়তি।”
“নিয়তি! তার মানে?”
“মানে বোঝার মতো বয়স তোমার হয়নি। তবে এ-ছেলেটা আসায় তোমাদের সুখের দিন শেষ হয়ে গেল। দুঃখের জন্য তৈরি হও। তিলে তিলে এতকাল ধরে যা তৈরি করেছিলাম, তার কিছুই বুঝি আর থাকে না।”
হাবুল বেশি কিছু বুঝতে পারল না। তবে তার মনে হচ্ছিল, দাদু যতটা দুঃখ করছেন, তো কিছু সর্বনাশ তাদের হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সে মুখে আর কিছু বলল না। হাতমুখ ধুয়ে আত্মিক সেরে পড়তে বসল।
পড়ার ঘরে বসে থেকেই হাবুল টের পেল, তার বাবা-কাকারা একে একে কাজের জায়গা থেকে ফিরে এলেন। কিছুক্ষণ পরেই দাদু তাঁদের নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন।