ঠিক এরকম সময়টায় হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে ষষ্ঠীর কাঁধে হাত রাখল।
ষষ্ঠী হঠাৎ চমকে উঠেই অভ্যাসবশে বলে ফেলল, “আমি না। সত্যি বলছি, আমি কিছু করিনি।”
কেউ ষষ্ঠীকে ধরলেই এই কথা বলা ষষ্ঠীর স্বভাব। ছেলেটা মৃদু একটু হাসির শব্দ করে বলল, “কী করেননি কানাইবাবু?”
ষষ্ঠী লজ্জা পেয়ে জিব কেটে বলে, “কত পাজি লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে। চোর গুণ্ডা পকেটমারের অভাব নেই। আমি কারও সাতে-পাঁচে থাকি না তো, তাই কেউ ধরলেই আগে সাফাইটা গেয়ে রাখি। এই তো সেদিন ভুনো-চোর পণ্ডিতবাড়ির খুকিটার নাকের নথ চুরি করল, আর মেধো পণ্ডিতের ছেলে রেমো এসে আমার ওপর কী চোটপাট! কলিকালটা খুব জেঁকে পড়েছে মশাই।”
“তা বটে। এবার তা হলে চলুন, আংটিটার একটা ব্যবস্থা করা যাক্।”
ষষ্ঠীর বুকটা খুব ঢিবঢিব করতে লেগেছে। যদি হিরে হয়? ওঃ, যদি হিরেই হয়? তা হলে আর তাকে পায় কে!
কালী স্যাকরার দোকান বাজারের মধ্যিখানে হলেও বেশ নিরিবিলি। খদ্দের বিশেষ আসে না। কালী স্যাকরার খদ্দেররা আসে নিশুত রাতে। চোরাই সোনা কেনাবেচা করে বলে তার দুনাম আছে। সুতরাং ভ ভদ্রলোক খদ্দের তার নেই। তার চেহারাটা বেশ গোলগাল, ব্যবহার ভারী অমায়িক।
আংটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনেকক্ষণ দেখল কালী। কষ্টিপাথরে ঘষল। এক চোখে একটা ঠুলি পরে নিয়ে পাথরটা পরখ করল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “পাথরটা আজ্ঞে পোখরাজই বটে। শ’ দুই টাকা দাম হবে এই বাজারে। আর সোনায় বলতে নেই মেলা পান। বাদসাদ দিলে সব মিলিয়ে মেরেকেটে শ’ চারেক টাকা দাম হয়। তা আপনি বিপদে পড়ে এসেছেন বলে ষষ্ঠী বলছিল, আমি নাহয় থোক সাড়ে চারশোই দিচ্ছি। আমার পঞ্চাশ টাকাও লাভ থাকবে কি না সন্দেহ।”
ছেলেটা আংটিটা কিছুক্ষণ মুঠোয় চেপে চোখ বুজে বসে রইল। বংশগত জিনিস হাতছাড়া করতে মনে কষ্ট হচ্ছে বলে ভাবল ষষ্ঠী। মুখে কিছু বলল না।
খানিকক্ষণ পর চোখ খুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেটা আংটি কালী স্যাকরার হাতে দিয়ে বলল, “তাই দিন তা হলে। আমার বড় বিপদ।”
কালী স্যাকরা খুব সহানুভূতির সঙ্গে বলল, “তা আর বলতে। দাম যাই হোক, পুরনো জিনিসের মায়াই কি কম? বিপদে না পড়লে কেউ কি হাতছাড়া করে?”
কালী আংটিটা লোহার সিন্দুকে রেখে সাড়ে চারশো টাকা গুনে গুনে ছেলেটার হাতে তুলে দিল।
জুলজুলে চোখে ষষ্ঠী পুরো ব্যাপারটা দেখল। বুকটা খুব ঢিবঢিব করছে। কালী স্যাকরার চোখে আলোর ঝলকানি দেখেই সে বুঝে নিয়েছে, আংটিটা ফঙ্গবেনে জিনিস নয়।
ছেলেটা টাকা নিয়ে গায়েব হয়ে যাওয়ার পর ষষ্ঠী একটা বিড়ি ধরিয়ে কালী স্যাকরার দিকে চেয়ে চোখ একটু মটকে বলল, “কী? বলেছিলুম না খুব দাঁও পেয়েছি একটা?”
কালী মুখটা গম্ভীর করে বলল, “দ্যাখ ষষ্ঠী, পাঁচকান করলে কিন্তু বিপদ ঘটবে। তোর তো আবার পেটে কথা থাকে না।”
ষষ্ঠী খুব গিলগিল করে হাসল। তারপর চাপা গলায় বলল, “দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে আংটিটা আর-একবার বের করো তো, একটু দেখি।”
কালী স্যাকরা উঠে দোকানের দরজাটা সাবধানে বন্ধ করে খিল এঁটে দিল। তারপর লণ্ঠনের সলতেটা তেজালোলা করে সিন্দুক খুলে আংটিটা বের করে আনল।
“হা সর্বনাশ!”
ষষ্ঠী চমকে উঠে বলল, “হল কী?”
কালী স্যাকরা হাতের তেলোয় আংটিটার দিকে অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে আছে, খাস প্রায় বন্ধ, চোখ কপালে।
ষষ্ঠী ব্যস্ত হয়ে বলল, “বলি ও কালী, অমন পাথর হয়ে গেলে কেন?”
কালী বিবর্ণ মুখে ষষ্ঠীর দিকে চেয়ে বলল, “এ যে নিজের চোখকে বিশ্বেস হচ্ছে না রে। ওইটুকু ছেলের এমন হাতসাফাই?”
“করেছেটা কী?”
কালী নিস্তেজ গলায় বলল, “এ আংটি সে আংটি নয়।”
“তার মানে?”
“যেটা দেখিয়েছিল সেটায় ভরিটাক সোনা, আসল হিরে। আর এটা স্রেফ পেতল আর কাঁচ। তিন পয়সা দাম।”
“বলো কী?” দুজনেই আহাম্মকের মতো হাঁ করে দুজনের দিকে চেয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে দাঁত কড়মড় করে ষষ্ঠী বলল, “আসল হিরেটার দাম কত বলো তো?”
কালী মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “কম করে ধরলেও লাখ টাকার কাছাকাছি। অত বড় হিরে আমি জন্মেও দেখিনি। আর জেল্লা কী।”
ষষ্ঠী নিজের ঊরুতে একটা চাপড় মেরে বলল, “বোকা বানিয়েছে! ঠিক আছে, আমিও দেখে নেব। ওই হিরে যদি বাগাতে না পারি তো আমার নাম ষষ্ঠী নয়।”
কালী স্যাকরা করুণ চোখে ষষ্ঠীর দিকে চেয়ে বলল, “তোর মনে শেষে এই ছিল রে? নিজের ভাইয়ের মতো তোকে ভালবাসতাম। শেষে কিনা একটা জোচ্চোরকে জুটিয়ে এনে আমার সর্বনাশ করলি?”
ষষ্ঠী দাঁত কড়মড় করে বলল, “তোমার সঙ্গে বেইমানি করলে আমার ধর্মে সইবে কালীদা? কোন্ দেবতার নামে দিব্যি করতে হবে বলো, করছি। ছোঁড়াটার সঙ্গে আজই চেনা হল। কিন্তু ও যে এত বড় ধুরন্ধর, তা মুখ দেখে বুঝতে পারিনি। তবে এই বলে রাখলাম, যেমন করেই হোক ও আংটি আমি উদ্ধার করে আনবই।”
কালী স্যাকরা মাথায় হাত দিয়ে বসে বলল, “পারবি? ছোঁড়া যে এলেম দেখিয়ে গেল, তাতে কাজটা সহজ হবে বলে মনে হয় না। খুব সাবধান।”
কথাটা ষষ্ঠীও হাড়ে-হাড়ে জানে যে, ছোঁকরার কাছ থেকে আসল আংটি বের করে আনা যার-তার কর্ম নয়। কিন্তু রাগের মাথায় মানুষের কত কী মনে হয়, হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা।
কালী স্যাকরার দোকান থেকে বেরিয়ে এসে ষষ্ঠী গনগন করতে করতে খানিক দূর হটল। এসপার-ওসপার একটা কিছু করতেই হবে আজ। কী করবে তাও সে খানিকটা আঁচ করে নিল। আজ রাতে সে রতন বাড়ুজ্যের বাড়ি হানা দেবে। একটা খুনে কুকুর আছে ওবাড়িতে। তা থাক। ষষ্ঠী বিষ মাখানো মাংসের টুকরো নিয়ে যাবে। কুকুরকে নিকেশ করে ছোঁকরাটাকে ঘুমের ওষুধ স্প্রে করে ঘুম পাড়াবে। এই দুই কর্ম জানালার বাইরে থেকেই করে নেওয়া যাবে। কাজগুলো হয়ে গেলে ঘরে ঢোকা জলবৎ তরলং। তারপরেও যদি কেউ বাধা দেয় তো ষষ্ঠীর ছোরা আছে, বাঘনখ আছে, ব্লেড আছে। অবশ্য আজ অবধি খুন দূরে থাক, ষষ্ঠী কাউকে তেমন জখমও করেনি। কিন্তু আজ করেই ফেলবে একটা এসপার-ওসপার।