হাবুল রান্নাঘরের দিক থেকে সরে এল।
উত্তরের ঘরখানা বেশ ভাল, তবে এ ঘরে কেউ থাকে না। দাদুর একখানা পুরনো ভারী সিন্দুক আছে, একটা বিলিতি লোহার ভারী ও প্রকাণ্ড আলমারি, আর অনেক কাগজপত্রের ডাঁই, কিন্তু ঘরখানার জানালা-দরজা খুলে দিলে ভারী আলো ঝকমকে, আর হাওয়ায় ভরা হয়ে যায়। একধারে বাগানের দোলনচাঁপা গাছগুলো থাকায় বর্ষাকালে চমৎকার গন্ধ আসবে।
হাবুল দেখল, উত্তরের ঘরে পুরনো আমলের খাটখানার ধুলো ঝেড়ে তাতে পরিপাটি বিছানা করছে, পাঁচুদা।
হাবুল ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, “ছেলেটা কে গো পাঁচুদা?”
পাঁচু মুখটা একটু বিকৃত করে বলল, “কে জানে দাদা? কখনও দেখিনি।”
হাবুল বলল, “দাদুও দেখেনি, কিন্তু দাদু ওকে চেনে।”
“তোমার দাদু মেলা লোককে চেনে। আর চিনেই হয়েছে ফ্যাসাদ। বেশি চেনা ভাল নয়।”
“ছেলেটা বোধহয় কোনও ভি. আই. পি. হবে, তাই না? যা খাতির যত্ন করা হচ্ছে…”
পাঁচু বিছানার চাঁদরটা নিখুঁত করে পেতে ভাল করে খুঁজে দিতে দিতে বলল, “পাঁটাকেও বলি দেওয়ার আগে খুব করে খাওয়ানো হয়, গলায় ঘি মালিশ করা হয়, মালা পরানো হয়। তাতে কী হল?”
হাবুল তুলনাটার অর্থ না বুঝে বলল, “তার মানে? ছেলেটাকে কি বলির পাঁটা বলে মনে হচ্ছে?”
বেজার মুখ করে পাঁচু বলে, “তা বলিনি, বরং উল্টোটাই। দেখে শুনে তো মনে হচ্ছে বলির পাঁটা আমরাই, উনি দু’দিনের জন্য উড়ে এসে জুড়ে বসলেন।”
এ রকম ব্যাখ্যায় হাবুল খুশি না হয়ে বলল, “তুমি তাহলে ছেলেটাকে চেনো!”
“না দাদা, কস্মিনকালেও চিনতাম না।”
“তবে কী করে বুঝলে যে, উড়ে এসে বসেছে? ছেলেটাকে দেখে দাদু অবধি কী রকম ঘাবড়ে গিয়েছিল জানো?”
একথায় কে জানে কেন পাঁচু হঠাৎ রেগে উঠল। দুখানা চোখ ঝলসে উঠল হঠাৎ। হাবুলের দিকে চেয়ে ঝাঁঝের গলায় বলল, “কাজের সময় অত বগবগ করবে না তো! যাও, নিজের কাজে যাও।”
হাবুল যে পাঁচুকে ভয় পায় এমন নয়। আসলে দাদু তাকে কোনও কিছুতে ভয় না-পেতেই শিখিয়েছেন। হাবুলের ভূতের ভয় নেই, অন্ধকারকে ভয় নেই, চোর ডাকাত পাগল কাউকে ভয় নেই। রাগী লোকদের সে খামোখা চটায় না বটে, তা বলে ভয়ও পায় না।
ছেলেটা সম্পর্কে কোনও খবরই যে সহজে পাওয়া যাবে না এটা আঁচ করে নিল হাবুল।
বিকেল হয়ে এসেছে বলে সে আর দেরি না করে ফুটবল খেলার বুটজোড়া আর শর্টস ও গেঞ্জির কিটব্যাগটা নিয়ে মাঠে রওনা হল।
তাদের ফটক থেকে বেরিয়ে ডানহাতে কিছুটা গেলেই প্রকাণ্ড খেলার মাঠ। এখনও সবাই আসেনি, দু-চারজন বল-পেটাপেটি করছে। হাবুল পোশাক আর বুট পরে মাঠে নেমে গেল।
০৪. বিকেলের আলো মরে এলে
বিকেলের আলো মরে এলে আমবাগানের ঈশেন কোণে গুটিগুটি ষষ্ঠী এসে দাঁড়িয়ে চোরা চোখে ইতিউতি চাইতে লাগল। বুকটা একটু ঢিবঢ়িব করছে। আংটির পাথরটা যদি হিরেই হয়, তা হলে যষ্ঠীকে আর ইহজন্মে ছ্যাঁচড়ামি করে বেঁচে থাকতে হবে না। হিরে হলে কালী স্যাকরার কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করে সে একটা বন্দুক কিনে ফেলবে, তারপর স্যাঙাত জুটিয়ে তৈরি করবে একটা ডাকাতের দল। ছোটখাটো কাজ আর নয়।
একটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ষষ্ঠী মশা তাড়াতে তাড়াতে ডাকাত হওয়ার কথা ভাবছিল, ভাবতেই কেমন যেন একটা শিহরণ জাগে শরীরে। এই অঞ্চলেই এক সময় বুক ফুলিয়ে ডাকাতি করে বেড়াত পানু মণ্ডল। যেমন বিশাল চেহারা, তেমনি তার দাপট। এখন বুড়ো বয়সে আর নিজে কিছু করে না, কিন্তু হাঁকডাকে এখনও বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খায়। তারই শিষ্য চিতে দাস হচ্ছে এখন সর্দার। তার দাপটও কিছু কম নয়, তবে লোকটা মিটমিটে ডান, হাঁকডাক। করে না, কিন্তু দারুণ বুদ্ধি রাখে। বুদ্ধি ষষ্ঠীরও কিছু কম নেই, তবে কিনা হাভাতেকে আর কে পোঁছে? একবার চিতে দাসের দলে ঢুকতে গিয়েছিল, ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বারদুয়ার থেকেই বিদেয় করে দিয়েছে।
হিরেটা যদি খাঁটি হয়, তাহলে ষষ্ঠী বন্দুক কিনে ফেলছেই। তারপর দুমদাম দু’দশটা করে লাশ পড়তে থাকবে তার হাতে। হাজার-হাজার লাখ-লাখ টাকা লুটেপুটে নিয়ে আসবে চারদিক থেকে। গণেশ কাংকারিয়ার গদি সাফ করবে, বৈজু লালোয়ানির বাড়ির ঠাকুরঘর থেকে লুকোনো সোনা বের করবে, যতীন সামন্তর বন্ধকি কারবারে জমা হওয়া জিনিসপত্র সোনারুপো গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে তুলে নিয়ে আসবে। শহরের দুটো ব্যাংকে ডাকাতি করলে মোটা টাকাই এসে যাবে হাতে। কয়েক লাখ টাকা হলে ষষ্ঠী তখন জুতো মসমঁসিয়ে নতুন লুঙ্গি পরে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বাজার থেকে রোজ ইলিশ মাছ আর কাটোয়ার ডাঁটা কিনে আনবে। ও দুটো খেতে সে খুব ভালবাসে। আর তেলেভাজা দিয়ে মুড়ি, রোজ খাবে। ভাবতে ভাবতে জিবে জল এসে গেল তার। উত্তেজনায় গাছের গুঁড়িতে একটা কিলও দিয়ে বসল।
কিন্তু ছেলেটা যে আসছে না। আসবে তো?
রতন বাঁড়ুজ্যে তোক বড় সুবিধের নয়। ছেলেটা যদি তার কাছে ষষ্ঠীর কথা সাতকাহন করে বলে থাকে, তবে তাকে চিনতে বুড়োর একলহমাও লাগবে না। তখন হয়তো ছেলেটাকে আসতে না দিয়ে নিজেই লাঠি বাগিয়ে এসে হাজির হবে।
ষষ্ঠী ভয়ে-ভয়ে চারদিকটা দেখে নিয়ে একটা ঝোঁপের আড়ালে আরও সরে দাঁড়াল।
অন্ধকারটা ক্রমে ক্রমে বেশ জমাট বেঁধে এল। মিটিমিটি জোনাকি জ্বলতে লেগেছে। আকাশে তারার পিদিম ফুটছে একটি-দুটি করে। ঘরে শাঁখ বাজতে লেগেছে।