“কে? কী নাম?”
“জিজ্ঞেস করিনি। একটা ছেলে।”
দাদু একটু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “অচেনা কেউ এলে আগে তার নাম-পরিচয় জেনে নিবি তো? বসিয়েছিস?”
“হ্যাঁ। বারান্দায়।”
“এই রোদ্দুরে বারান্দায়?”
“এল না যে ভিতরে।”
দাদু আর বাক্যব্যয় না করে খড়মের শব্দ তুলে বারান্দায় এলেন। মুখোনা গম্ভীর, একটু অপ্রসন্ন।
ছেলেটা চেয়ারে বসে ঢুলছিল। দেখেই বোঝা যায়, ভীষণ ক্লান্ত। দাদু কিছুক্ষণ নীরবে ছেলেটিকে লক্ষ করলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “মনে হচ্ছে রামদুলালের নাতি।”
হাবুল বলল, “রামদুলাল কে দাদু?”
দাদুর মুখচোখ হঠাৎ খুব ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল। চোখের দৃষ্টি যেন বহু দূরে চলে গেছে। কিছুক্ষণ চুপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছেলেটির দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর দূরের দিকে।
হাবুল আর কিছু জিজ্ঞেস করতে ভরসা পেল না। দাদু পিছু ফিরে ঘরের দিকে রওনা দিতে দিতে তাকে বললেন, “ও ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক। অনেকটা রাস্তা আসতে হয়েছে। জাগলে পরে আমার ঘরে নিয়ে আসিস। তোর মাকে বল ভাল করে জলখাবার বানাতে। আর বেণুকে ডেকে উত্তরের ঘরখানা সাফ করে রাখতে বলে দে। ভাল করে যেন বিছানা পেতে রাখে।”
হাবুল মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা।”
দাদু ধীর পায়ে, অনেকটা যেন নিজের শরীরের ভার টানতে টানতে, ঘরে ফিরে গেলেন।
দাদুকে এত অন্যমনস্ক আর বিষণ্ণ হতে আর কখনও দেখেনি হাবুল। তার চেয়েও বড় কথা, দাদুর চোখে একটু ভয়ের আভাসও দেখতে পেয়েছে সে। রতন বাড়ুজ্যে সম্পর্কে যে যাই বলুক, এটা সবাই জানে, এরকম ডাকাবুকো তোক এ-তল্লাটে আর নেই। সেই দাদুর চোখে একটা চাপা আতঙ্কের ছাপ দেখে হাবুল খুব অবাক হল। একটা অচেনা ছেলে–রামদুলাল না কার নাতি–তাকে দেখে এতটা ঘাবড়ে যাওয়ার কী আছে?
হাবুল গিয়ে মাকে জলখাবারের কথা আর বেণুকে ঘর সাজানোর কথা বলে বারান্দায় ফিরে এল। এসে দেখে, ছেলেটা সোজা হয়ে বসে জামগাছে বসে থাকা একটা ঘুঘুপাখির দিকে চেয়ে আছে।
হাবুল বলল, “শুনছেন? দাদু আপনার জন্যে বসে আছেন।”
ছেলেটা কথাটা কানে তুলল না। হাবুলের দিকে চেয়ে বলল, “তুমি কখনও ঘুঘুপাখির মাংস খেয়েছ?”
“না। কেন?”
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, “না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। গত কয়েক মাসে আমাকে অনেকরকম খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে। পুরুলিয়ার জঙ্গলে একবার একটা ঘুঘুকে পুড়িয়ে খেতে হয়েছিল। জীবজন্তু পাখি এসব মারতে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু সেই ঘুঘুটাকে না মারলে আমি খিদের জ্বালায় বোধহয় মরেই যেতাম।”
এই বলে রামদুলালের নাতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর হাবুলের দিকে একটু রহস্যময় চোখে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “আমাকে দেখে
তোমার দাদু বোধহয় খুশি হননি, না?”
হাবুল অবাক হয়ে বলে, “দাদু যে আপনাকে দেখেছেন তা জানলেন কী করে? আপনি তো বসে ঢুলছিলেন?”
“আমি কখনও পুরোপুরি ঘুমোই না। ঘুমোলেই বিপদ। তাই সবসময়ে আমার ভিতরে একজন জেগে থাকে। পাহারা দেয়।”
বলে ছেলেটা উঠে দাঁড়াল।
হাবুল তাকে দাদুর ঘর অবধি পৌঁছে দিল। দাদু ইজিচেয়ারে বসে ছিলেন। উঠে এসে ছেলেটাকে হাতে ধরে ঘরে গিয়ে কপাট বন্ধ করে দেওয়ার আগে হাবুলকে বললেন, “আধঘণ্টা যেন কেউ আমাদের বিরক্ত না করে।”
হাবুল শুনেছে তার দাদু রতন বন্দ্যোপাধ্যায় একসময়ে খুবই গরিব ছিলেন। তার বাবা ছিলেন পুরোহিত। তিনিও ওই বৃত্তিতেই দিন গুজরান করতেন কোনও রকমে। একবার গায়ে খুব আকাল দেখা দিল। খরায় সেবার গাছপালা মরে গেল, মাটি শুকিয়ে হয়ে গেল ঝুরঝুরে। কুয়ো শুকোল, পুকুর শুকোল, এক ফোঁটা খাওয়ার জল পর্যন্ত জোটে না। রতন বাড়জ্যে তখন সপরিবারে বেরিয়ে পড়লেন হারা-উদ্দেশে। গিয়ে ঠেকলেন সাঁওতাল পরগনায়। শোনা যায় সেখানে ভাগ্যক্রমে তিনি এক ধনী লোকের আশ্রয় লাভ করেন। আর তারপরেই তার কপাল ফিরে যায়।
কিন্তু দাদুর এই ভাগ্য পরিবর্তন সম্পর্কেও অনেক কুলোকে কুকথা বলে। কেউ বলে, দাদু নাকি লোকটাকে খুন করে সম্পত্তি হাতিয়ে নেন। কেউ বলে, উনি চুরি করে পালান।
সত্যিকারের কী ঘটেছিল, তা কেউ জানে না। একমাত্র পাঁচুদা হয়তো বা কিছু জানতে পারে। কিন্তু তার মুখ থেকে কোনওদিনই কিছু বেরোবে না। হাবুল লক্ষ করল, রান্নাঘরে সুখনের মা ময়দা ঠাসছে।
বেণু উনুনে গুঁড়ো কয়লার ঢিমে আঁচ চেতিয়ে তুলছে ভাঙা লটপটে একটা হাতপাখার বাতাসে। বেণুর সঙ্গে সুখনের মায়ের একটুও বনে না। দু’জনে এক জায়গায় হলেই ঝগড়া লাগে। আজও হচ্ছিল।
সুখনের মা বলছিল, “এই যে নবাবনন্দন, সব-কিছু খুব সিধে দেখেছ না? চৌপর দিন তো গুলতি নিয়ে কাকবক শিকার করে বেড়াও আর বাগানের জাম জামরুল আম আতা পেড়ে-পেড়ে পেটে পেপারো, সব জানি, বলি, তোমাকে কি শুধু টেরি বাগানের জন্য রাখা হয়েছে?”
বেণু বেজায় ধোঁয়া তুলে লকলকে আগুনের শিখা বের করে ফেলতে ফেলতে বলল, “মাসি, তোমার মতো কি আর আমাদের কপাল? তোমার কপালের নাম হল সাক্ষাৎ গোপাল, বাপের বাড়ির ঝি, তার পান্তাভাতে ঘি। সুখে থেকে-থেকে তেল-চুকচুকে চেহারাখান হয়েছে বটে, কিন্তু মাসি, আমার ওপর তোমার অত নেকনজর কেন? বেশি কটর কটর করবে তো ফের সেদিনের মতো বালিশের তলায় জ্যান্ত ব্যাঙ চাপা দিয়ে রেখে আসব।”