ফটকের বাইরে একজন লোক পঁড়িয়ে আছে। বেশ মলিন পোশাক, ক্লান্ত চেহারা। কুঁজোটা বারান্দায় রেখে হাবুল এগিয়ে গেল।
“কাকে চাইছেন?”
ছেলেটা অবাক হয়ে বাড়িটা দেখছিল। কিছুক্ষণ জবাব দিল না। তারপর একটা ময়লা রুমালে মুখ মুছে বলল, “রতন বাড়ুজ্যের বাড়ি কি এইটে?”
“হ্যাঁ। আমার দাদু।”
“আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
দাদু দুপুরে ঘুমোন না বটে, কিন্তু নিজের ঘরে বসে বিশ্রাম করেন। এ-সময়টা অনেক পুঁথিপত্র ঘাটাঘাটি করা তার অভ্যাস। দুপুরে তাকে ডাকাডাকি করা বারণ।
হাবুল বলল, “দাদুর সঙ্গে এখন তো দেখা হবে না। বিকেল চারটের পর তিনি ঘর থেকে বেরোবেন।”
ছেলেটা হাবুলের দিকে করুণ চোখে চেয়ে বলল, “আমি অনেক দূর থেকে আসছি। খুব ক্লান্ত। আমাকে একটু বসতে দেবে কোথাও? ওই বারান্দায় বসলে কোনও অসুবিধে আছে?”
হাবুল বলল, “হ্যাঁ, বারান্দায় কেন, বাইরের ঘরেও বসতে পারেন। কোনও অসুবিধে নেই। আসুন।”
ছেলেটা ফটক খুলে ভিতরে এল। তারপর হাবুলের পিছু-পিছু এসে বারান্দায় উঠে চারদিকটা চেয়ে দেখতে লাগল। কুকুরটা রাগে ঘড়ড় ঘড়ড় শব্দ করছে, কিন্তু হাবুলের ভয়ে চেঁচাচ্ছে না।
লোকটা ঘরে ঢুকল না। পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বারান্দার একটা কাঠের চেয়ারে বসে ক্লান্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
হাবুল কুঁজো নিয়ে বাগানের টিউবওয়েল থেকে জল আনতে গেল। মিনিট দশেক বাদে ফিরে এসে সে দৃশ্য দেখে অবাক। ছেলেটা তাদের কুকুরটার কাছে গিয়ে উবু হয়ে বসেছে, আর গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তাদের কুকুর টমি নির্লজ্জ বেহায়ার মতো চিৎপাত হয়ে শুয়ে চার ঠ্যাং নুলো করে আদর খাচ্ছে।
ডবারম্যান এমনিতেই খুনি কুকুর। দারুণ তেজ, ভয়ংকর সাহস। পাহারাদার কুকুর হিসেবে ডবারম্যান বিপজ্জনকও বটে। তাই টমি এত সহজে এরকম আনকোরা এক আগন্তুকের বশ মেনেছে দেখে হাবুল প্রথমটায় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
ছেলেটা হাবুলের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলল, “আমাদের বাড়িতে অনেক কুকুর ছিল। আমি কুকুরদের একটু-একটু বশ করতে পারি।”
হাবুলের বিস্ময় তবু কাটেনি। সে বলল, “কিন্তু টমি আজ অবধি কোনও অচেনা লোককে সহ্য করেনি।”
ছেলেটা উদাস স্বরে বলল, “অধিকাংশ লোকই কুকুরকে অকারণে ভয় পায়। কুকুরদের স্বভাব জানা থাকলে ভয়ের কিছু নেই। আমি তো গ্রামে-গঞ্জে কত কুকুরের পাল্লায় পড়েছি!”
“তাই নাকি?”
ছেলেটা উদাস মুখে বলল, “শুধু কুকুর? নেকড়ে বাঘ, সাপ, বুনো হাতি, খ্যাপা শেয়াল, ডাকাত, বাটপাড়, চোর, জীবজন্তুদের স্বভাব আমার জানা, তাই তাদের নিয়ে অসুবিধে হয় না। অসুবিধে পাজি মানুষকে নিয়ে।”
গল্পের গন্ধ পেয়ে হাবুল কুঁজোটা রেখে একটা কাঠের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে বলল, “সত্যি? বলুন তো আপনার অভিজ্ঞতার কথা, একটু শুনি।”
“শুনবে? আচ্ছা বলব’খন। তোমাদের বাগানে ওই যে জামগাছটায় অনেক জাম ফলে আছে, আমি কয়েকটা পেড়ে খাব?”
হাবুল তাড়াতাড়ি উঠে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। পঁড়ান, আমি লগি দিয়ে পেড়ে দিচ্ছি।”
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, “লগি দিয়ে পাড়লে পাকা জাম থেঁতলে যায়। দরকার নেই, আমি চমৎকার গাছ বাইতে পারি। এইভাবেই তো আমাকে বেঁচে থাকতে হয়।”
এই বলে ছেলেটা বানরের মতো তরতর করে উঁচু গাছটায় চোখের পলকে উঠে গেল। চার-পাঁচ মিনিট বাদেই প্রায় মগডাল থেকে এক থোকা পাকা জাম নিয়ে নেমে এল।
হাবুল নিজেও এত ভাল গাছ বাইতে পারে না। সুতরাং ছেলেটার ওপর তার বেশ শ্ৰদ্ধা হল।
ছেলেটা এসে পাশের চেয়ারে বসে একটা জাম মুখে ফেলে থোকাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “খাও।”
“আপনি খান। আমার জাম খেতে-খেতে অরুচি।”
“বেশ জাম।” বলে ছেলেটা ক্ষুধার্তের মতো খেতে লাগল। হাবুল হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “আপনি আমার দাদুর কাছে কেন এসেছেন?”
ছেলেটা জাম খেয়ে বিচিগুলো বা হাতের তেলোয় জমা করছিল। অর্থাৎ সহবত জানে। অন্য কেউ হলে বিচিটা মুখ থেকেই ফুঃ করে ছুঁড়ে দিত বারান্দার বাইরে। একসঙ্গে গোটা তিনেক বিচি মুখ থেক বের করে ছেলেটা তার দিকে চেয়ে বলল, “কেন যে এসেছি, তা আমিই জানি না। তবে আমার দাদু মরার সময় আমাকে বলেছিলেন, বিপদে পড়লে রতন বাড়ুজ্যের কাছে যাস।”
কিছু মানুষ আছে, যাদের দেখলেই কেমন যেন ভাল লাগে, তাদের কাছে দু দণ্ড বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। হাবুলের কাছে তেমন মানুষ একজন হল দাদু। আর একজন ছিলেন স্কুলের ইতিহাসের স্যার পরিতোষবাবু। গত বছর পরিতোষবাবু মারা যান ডাকাতের গুলিতে। পাশের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল, পরিতোষবাবু গিয়েছিলেন তাদের বাচাতে। তৃতীয় আর একজন হল এই ছেলেটি। একে দেখেই হাবুলের বেশ ভাল লাগছে। চেহারাখানা যেমন ভাল, ব্যবহারটি তেমনি মিষ্টি।
হাবুল বলল, “দাদু ছাড়া আপনার আর কে আছে?”
“দাদু নেই, কেউ নেই। আমি একদম একা।”
কথাটা এমন উদাস নিস্পৃহ গলায় বলল যে, হাবুলের বুকের মধ্যে কষ্ট হল একটু। সে বলল, “আপনি বসুন, আমি বরং দাদুকে ডেকে আনি।”
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, “তাড়া নেই। আমি বসছি। উনি বিশ্রাম করছেন করুন।”
“আচ্ছা।” বলে হাবুল ঘরে চলে এল। কিন্তু আর লেখাপড়ায় তেমন মন বসল না।
০৩. দাদুর ঘরের দরজা
ঠিক চারটের সময় দাদুর ঘরের দরজা খুট করে খুলে যেতেই হাবুল গিয়ে হাজির। “দাদু, তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে।”