আমবাগানে বেড়া আছে। ঢোকা বারণ। তবে সব বারণ শুনে চলতে গেলে ষষ্ঠীকে কবে পটল তুলতে হত। তাই তারের বেড়াটা ডিঙিয়ে আমবাগানে ঢুকে ষষ্ঠী একবার চৌকিদারদের দিকে তাকাল। একজন খাঁটিয়ায় শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। অন্যটা বসে খৈনি ডলছে। ষষ্ঠী টুক করে গোটা দুই আম পেড়ে নিল হাত বাড়িয়ে। কলমের গাছ, হাতের নাগালেই ফল। পেড়েই মাথা নিচু করে একটু চোটে হেঁটে বাগানের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে রাস্তায় পড়ল। যা পাওয়া যায় তা-ই লাভ। দুনিয়ায় কোনওটাই তো ফেলনা নয়। গাড়িবারান্দার তলায় বসে ষষ্ঠী ভাবতে লাগল, ছোঁড়াটা বিকেলে এলে হয়।
০২. সকালবেলাটায় হাবুল থাকে
সকালবেলাটায় হাবুল থাকে তার দাদুর কজায়। দাদু ওঠেন রাত তিনটেয়। জপতপ সারতে চারটে বেজে যায়। শীত গ্রীষ্ম বলে কথা নেই, দেওয়াল-ঘড়িতে কাঁটায়-কাঁটায় সাড়ে চারটে বাজবার টং শব্দ হতে না হতেই দাদুর হাঁক শোনা যায়, “হাবুল!”
দাদুর গলার জোর প্রায় কিংবদন্তী। এই গলায় মরা মানুষের নাম ধরে হাঁক মারলে মড়াও উঠে বসবে। অন্তত দাদুর বন্ধু অনাথ সান্যাল, কুমুদ বোস, মহিম বিশ্বাস বা যতীন সামন্তর মতো লোক তাই বলেন। শোনা যায়, দাদুর যখন দশ বারো বছর বয়স, তখন একবার বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। দাদু উত্তেজিত হয়ে “ধর ব্যাটাদের, মার ব্যাটাদের” বলে এমন চেঁচিয়েছিলেন যে, ডাকাতরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়।
যাই হোক, সেই গলার একটি হাঁকেই হাবুলের গাঢ় ঘুম আঁতকে উঠে পালায়। ডাক্তাররা বলে, মানুষের আট ঘন্টা ঘুম দরকার। দাদু বলেন, “দূর, চার ঘন্টা ঘুম পাড়লেই বহুত। বেশি ঘুমোলে জীবনটাকে দেখবি কখন। ঘুম বেশি করতে নেই। দুনিয়ায় কত কী দেখার আছে, বোঝার আছে, শোনার আছে, ভাবার আছে।”
কিছুদিন আগে হাবুলের পৈতে হয়েছে। এখনও মাথা কদমফুল। সকালে উঠে তাকেও আহ্নিক করতে হয়। তারপর থানকুনি পাতা আর জল খেয়ে নিয়ে শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ আর ব্যায়াম।
এইভাবে ঘন্টা দুয়েক ধরে দাদু তাকে তৈরি করে ছেড়ে দেন। কিন্তু তারপরও সারা দিন ধরে দাদুর একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব তার ওপর কাজ করতে থাকে।
স্কুলে গ্রীষ্মের বন্ধ শুরু হয়েছে। ঝাঁঝ দুপুরে নিজের ঘরে বসে হাবুল হোমটাস্ক করছিল। এমন সময় তাদের ডবারম্যান কুকুরটা ঘাউ-ঘাউ করে ডেকে উঠল। হয়তো ভিখিরি বা পুরনো কাগজওয়ালা এসেছে। একটা শক্ত অঙ্ক মেলাতে গলদঘর্ম হচ্ছিল হাবুল, তাই কুকুরের ডাক গ্রাহ্য করল না। বুড়ো দরোয়ান রামরিখ কানে ভাল শুনতে পায় না, চোখেও দেখে না। তার ওপর দিনরাত হয় ঘুমোয়, না হলে বসে বসে চুলে। বাড়িতে কাজের লোক অবশ্য দু’চারজন আছে। তার মধ্যে পাচু হল প্রধান। বয়স জিজ্ঞেস করলে বলে, “দেড়শো দুশো বছর তো হবেই।” কালো, লম্বা, পাকানো চেহারা, মাথাভর্তি সাদা চুল আর একজোড়া মিলিটারি কায়দার মোটা সাদা গোফ সমেত পাঁচুর বয়সের আন্দাজ পাওয়া সত্যিই শক্ত। সে আবার দাদু ছাড়া বাড়ির আর কাউকে বিশেষ গ্রাহ্য করে না। বরং উল্টে তাকেই সবাই খাতির করে। কবে যে সে এবাড়ির কাজে ঢুকেছিল তা কেউ জানে না। হাবুলের বাবা কাকা সকলেই তাকে জ্ঞান হওয়া অবধি দেখে আসছে।
আর আছে বেণু নামে ছোঁকরা একটা চাকর। বেশ চালাক-চতুর আর চটপটে। তবে খুব ফাঁকিবাজ, সুখনের মা হল এ বাড়ির বুড়ি-ঝি। সে এসেছিল হাবুলের মায়ের বাপের বাড়ি থেকে। খুব ডাকসাইটে মহিলা, ঝি বলে মনেই হয় না। তবে সে খুব কাজের লোক। তাকে হুকুম দিয়ে কাজ করানো যায় না, কিন্তু নিজে থেকে সে যখনকার যা কাজ তা নিখুঁতভাবে করে।
বাড়িতে এতগুলো কাজের লোক থাকলেও হাবুলকে নিজের সব কাজ নিজেকেই করে নিতে হয়। দাদুর সেইরকমই আদেশ আছে। সে নিজের জামাকাপড় নিজে কাঁচে, নিজের জুতো নিজেই বুরুশ করে, নিজের ঘরখানাও তাকেই ঝাড়পোছ করতে হয়, নিজের এঁটো থালাও মাজতে হয়। দাদু বলেন, “দেখ হাবুল, এ-দেশটা গরিব বলে আমরা কাজের লোক রাখতে পারি। কিন্তু দেশটা যদি উন্নত হত, তা হলে কম পয়সায় কাজের লোক রাখা সম্ভব হত না। সব কাজ নিজেকেই করতে হত। একদিন যখন দেশটার ভোল পাল্টাবে, তখন তো কাজের লোকের অভাবে তোরা অথই জলে পড়বি। তার চেয়ে অভ্যাস রাখা ভাল। আর নিজের কাজ নিজে করলে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।”
গরমের দুপুরে হাবুলের এখন খুব জলতেষ্টা পেয়েছে। কুঁজোর জল একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে। বাগানের এক কোণে একটা টিউবওয়েল আছে, তার জল ভারী মিষ্টি আর ঠাণ্ডা। অঙ্কটা মেলানোর পর জল
আনতে যাবে বলে ভেবেছিল হাবুল। কিন্তু কুকুরটা একনাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে আর ঘনঘন শিকলের শব্দ করছে। কে এল একবার দেখা দরকার। তাই হাবুল উঠল।
কিন্তু উঠতে মনে পড়ল দাদু বলে দিয়েছেন, “হাতের কাজ শেষ না করে কিছুতেই অন্য কাজে যাবে ন। শত কষ্ট হলেও না।”
হাবুল ফের বসে পড়ল। অঙ্কটা কেটে দিয়ে আবার নতুন সাদা পাতায় শুরু করল। এবার দু’মিনিটেই মিলে গেল অঙ্কটা।
কুঁজো নিয়ে হাবুল বেরিয়ে এল। বাইরে ঝাঝা রোদ। আকাশে এতটুকু মেঘ নেই। হাওয়া বইছে না। চারদিক থমথম করছে। বারান্দায় শিকলে বাধা কুকুরটা প্রচণ্ড লাফালাফি করছে। হাবুলকে দেখে কুকুরটা উৎসাহ পেয়ে আরও চেঁচাতে লাগল। হাবুল একটা ধমক দিতেই কুকুরটা চুপ করে বসে জিব বের করে হ্যাঁহ্যাঁ হাফাতে থাকে।