গন্ধর্ব একটু কঠিন স্বরে বলল, “কিসের বিদ্যে আর কিসেরই বা হাতসাফাই বলুন তো! আমি তো কিছুই জানি না।”
“আজ্ঞে, গুণীদের তো বিনয় থাকবেই। তবে কিনা এই গরিবকে কেন মিছে ছলনা করছেন কুমারবাহাদুর? নিজের চোখে না দেখলে প্রত্যয় হত না।” বলতে বলতে ষষ্ঠী আনন্দাশ্রু বিসর্জন করতে লাগল। ধুতির খুঁটে চোখ মুছতে-মুছতে বলল, “আহা, কী দেখলাম! চোখ যেন জুড়িয়ে গেল। অমন ধুরন্ধর কালী-স্যাকরা পর্যন্ত স্বীকার করল, হ্যাঁ, ওস্তাদ লোক বটে। তারপর টিকে গুণ্ডার মতো দশাসই লাশটাকে কী হেনস্থাই করলেন। এইটুকু বয়সে এমন উঁচু দরের ওস্তাদ হলেন কী করে সেটাই ভেবে অবাক হচ্ছি।”
লোহিত এতক্ষণ অন্ধকারে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। পেতলের বাক্সটা এক কাঁধ থেকে আর এক কাঁধে চালান করে সে এবার একটা বাঘা ধমক দিল, “চোপ কর বেয়াদপ! কার সঙ্গে কথা বলছিস জানিস?”
ষষ্ঠী তিন হাত লাফিয়ে উঠে বুকে হাত চেপে ধরে জুলজুল করে চেয়ে বলল, “ওরে বাবা রে? উটি আবার কে কুমারবাহাদুর? মানুষের মূর্তি দেখছি। ও বাবা, ওর যে আবার সন্ন্যাসীর ভেক।”
লোহিত বাক্সটা মাটিতে নামিয়ে রেখে ত্রিশূলটা বাগিয়ে ধরে গন্ধর্বকে জিজ্ঞেস করল, “লোকটা কে কুমার?”
গন্ধর্ব মৃদু হেসে বলল, “কানাইবাবু, ভাল লোক। তবে দোষের মধ্যে রাতের বেলা একটু বেরোন-টেরোন আর কি।”
লোহিত ত্রিশূলটা তুলে বলল, “দশ গুনতে-গুনতে হাওয়া হয়ে যা। নইলে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেব।”
ষষ্ঠী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “কিন্তু আমি তো কিছু করিনি। কুমারবাহাদুরকে শুধু গুরু বলে মানছি। উনি যদি আমাকে শিষ্য করে নেন তো চিরজীবন কেনা গোলাম হয়ে থাকব। আমার কথায় বিশ্বাস না হয় ওঁর কোমরের গেজেটা খুলে দেখুন। কালী-স্যাকরার সর্বস্ব ওর মধ্যে আছে।”
লোহিত একটু বিরক্তির স্বরে গন্ধর্বকে বলল, “এ লোকটা কী বলছে? কালী-স্যাকরার কাছ থেকে…”
গন্ধর্ব মৃদু স্বরে বলল, “তেমন কিছু নয়। পরে বলব।”
লোহিত যেন এ কথায় খুশি হল না। বিড়বিড় করে বলল, “কথাটা আগে বলা উচিত ছিল।”
গন্ধর্ব মিনমিন করে বলল, “সময় পেলাম কই! বলতাম ঠিকই।”
লোহিত হাত বাড়িয়ে বলল, “গেজেটা দেখি।”
গন্ধর্ব তার কোমরে হাত চেপে ধরে বলল, “না। এটা আমার রোজগার।”
লোহিত বাঘা গলায় বলল, “চালাকি কোরো না। তাতে ভাল হবে না। রাজার ছেলের মতো আচরণ না করে চোরের মতো করেছ। স্বভাব যাবে কোথায়? এখন গেজেটা দাও। যা আছে তার বখরা সবাই পাবে।”
বলতে বলতে লোহিত ষষ্ঠীর দিকে একবার তাকাল। কিন্তু ষষ্ঠী কোথায়? তার চিহ্নও নেই।
লোহিত চকিতে চারদিকে চাইল। তারপর পেতলের বাক্সটা টপ করে ঘাড়ে তুলে নিয়ে বলল, “লোকটা পালিয়েছে। আর দেরি করা ঠিক নয়। তাড়াতাড়ি চলো।”
বলে লোহিত পা বাড়াতেই ঝপ করে একটা মাছধরার জাল নিখুঁতভাবে এসে তাকে ছেয়ে ফেলল। টাল সামলাতে না পেরে বাক্স সমেত দড়াম করে পড়ে গেল সে।
একটা টর্চের আলো এসে পড়ল গন্ধর্বের মুখে। একটা গম্ভীর গলা বলে উঠল, “এই যে নকল নারায়ণ রায়, অভিনয়টা চমৎকার করে গেছ ভাই। শুধু এই শেষ সময়টায় ফেঁসে গেলে।”
গন্ধর্ব সামান্য একটু হাসল। তারপরই একটা চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্রতায় মাথার ওপর একটা ডাল লাফিয়ে ধরে তীব্র একটা ঝুল খেয়ে সে পা বাড়িয়ে টর্চধারীর হাতে লাথি মারল। টর্চটা উড়ে গিয়ে গাছের ডালে আটকে রইল।
অন্ধকারে তখন শুরু হল এক দারুণ লড়াই।
কে জিতছে, কে হারছে তা বলা শক্ত। তবে দু’পক্ষই বোঝা গেল শক্ত ধাতের লোক। কেউ কারও চেয়ে কম যায় না। ঘুসি, লাথি, ক্যারাটে, কুংফু সব কিছুই চলতে লাগল।
১০. আমবাগানের পশ্চিম দিকটায় বাঁশঝাড়
আমবাগানের পশ্চিম দিকটায় বাঁশঝাড়ের পাশে নির্জন জায়গায় একটা শুকনো খাদের ধারে এসে দাঁড়াল শ্বেত। হাতে ভয়ংকর শূল। মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি।
তার পিছনে রতনবাবু। তাঁর মুখে হাসি নেই, ভয়ও নেই।
শ্বেত বলল, “রতনবাবু, অনেকদিন ধরেই আমি এই মুহূর্তটির অপেক্ষা করছিলাম। রাজাসাহেবকে বশ করে একসময়ে তুমিই রাজ্যপাট চালাতে শুরু করেছিলে। রাজবাড়ির গুপ্তধন আবিষ্কার করে সেটা রাজাকে দিয়ে তুমি একটু সততার পরিচয় দিয়েছিলে ঠিকই, কিন্তু সেই গুপ্তধনের জন্যই রাজপরিবারে অশান্তি নেমে আসে। তোমার ষড়যন্ত্রেই গুপ্তধনের কথা ফাঁস হয়ে যায়। আর তার ফলেই রামদুলাল প্রায় নির্বংশ হয়ে যান। আজ তোমাকে বধ করে সেই ঘটনার শোধ নেব।”
রতনবাবু অকম্পিত কণ্ঠে বললেন, “সব জানি হে শ্বেত। নির্লোভ, সদাচারী, সত্যনিষ্ঠ দেখে রামদুলাল আমাকে তাঁর কাছে রেখেছিল। কিন্তু তোমরা আমাকে সহ্য করতে পারতে না। আমি অনেক জোচ্চুরি, বাটপাড়ি ধরে ফেলতাম। তোমরা তক্কেতক্কে ছিলে আমাকে নিকেশ করার জন্য। রামদুলালের জন্য তখন পারোনি। স্বজন-বিদ্রোহে রামদুলালের পরিবার শেষ হয়ে যাওয়ায় আর আমি চলে আসায় তোমাদের সুযোগ হাতছাড়া হয়। আজ সুযোগ পেয়েছ। মারো আমি এই তৃপ্তি নিয়ে মরব যে, আমি আজও সত্যনিষ্ঠ, সত্যবাদী।”
খেতের চোখ অন্ধকারে একবার জ্বলে উঠল। গম্ভীর স্বরে সে বলল, “ইষ্টনাম স্মরণ করো রতনবাবু।”
“করছি। আমি সর্বদাই ইষ্টনাম স্মরণ করি।”
শ্বেত তার ভয়ংকর তীক্ষ্ণ শূল উদ্যত করল। রতনবাবু নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলেন।