সুতরাং ষষ্ঠী অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর দেওয়ালে একটা গেঁয়ো পিঁপড়েকে বাইতে দেখে সেটাকে সাবধানে তুলে এনে ছোঁকরার ঘাড়ে ছেড়ে দিল।
কাজ হল। কিছুক্ষণ পরেই ছোঁকরা ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে সোজা হয়ে বসল।
ষষ্ঠী খুব বিগলিত মুখে বলল, “বড্ড পিঁপড়ে ভাই। আমাকেও একটা কামড়েছে।” বলে বেশ জোরে জোরে নিজের গোড়ালি ডলতে লাগল সে।
ছেলেটা একটা ময়লা রুমালে মুখের ঘাম মুছল। তারপর উদাস চোখে চেয়ে রইল সামনের দিকে। অনেকক্ষণ বাদে বলল, “আচ্ছা, এইখানে
রতনলাল বাঁড়ুজ্যের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?”
ষষ্ঠী একটু চমকে উঠল। মুখের হাসিটাও মিলিয়ে গেল। গলা-খাঁকরি দিয়ে বলল, “তিনি আপনার কে হন আজ্ঞে?”
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, “কেউ না, উনি ব্রাহ্মণ আমি কায়স্থ। আত্মীয়তা নেই।”
“চেনাজানা নাকি?”
ছেলেটা ফের মাথা নেড়ে বলে, “তাও নয়। তবে আমার দাদু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলে গেছেন, আমি তাঁর কাছেই এসেছি।”
ষষ্ঠী ছোঁকরার আঙুলের আংটিটার দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাঃ, আংটিটা হাতানোর আর কোনও উপায় রইল না। রতন বাঁড়ুজ্যের কুটুম, জ্ঞাতি, চেনাজানা কারও কাছ থেকে কিছু হাতিয়ে নেবার মতো বুকের পাটা এ-তল্লাটে কারও নেই।
ষষ্ঠী উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে গলির উত্তর প্রান্তটা হাত তুলে দেখিয়ে বলল, “গলিটা পেরিয়ে আমবাগান আর পুকুর পাবেন। তারপর মস্ত লালরঙা বাড়ি। ওটাই রতনবাবুদের।”
ছেলেটা খুব সরল একটু হাসি হেসে বলল, “আপনি বেশ ভাল লোক, আচ্ছা, আজ তা হলে চলি।” ষষ্ঠী ফের গাড়িবারান্দার তলায় বসতে যাচ্ছিল।
ছেলেটা যেতে গিয়ে আবার ফিরে এসে বলল, “এই যে, একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।”
“কী কথা?”
“আপনার নামটা বলবেন? ভাল লোকদের নাম জেনে রাখা ভাল।”
ষষ্ঠী একটু মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে ওইখানেই তো গোলমাল। লোক যে আমি তেমন মন্দ ছিলাম না সে আমিও বুঝি। কিন্তু অন্য লোকেরা কি সে কথা মানতে চাইবে? ওই রতন বাঁড়ুজ্যের কাছেই নামটা বলে দেখুন না কেমন খ্যাঁক করে ওঠে।”
“তা নামটা কী?”
ষষ্ঠী মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “কানাই নামটা কেমন?”
“কানাই! বাঃ, বেশ নাম। আপনার নাম কি কানাই?”
ষষ্ঠী বিগলিত একটু হেসে বলল, “ঠিক কানাইও নয়, তবে কাছাকাছি। আপাতত কানাই দিয়েই চালিয়ে নিন না।”
ছেলেটা ঘাড় কাত করে বলল, “বেশ। তাই হবে। আর একটা কথা।”
“আবার কী?”
“আমার হাতে এই যে আংটিটা দেখছেন, এটা বেচতে চাই। এখানে এমন আংটি কেনার লোক আছে? আমার বড় অভাব।”
ষষ্ঠী আংটির কথায় একটু থতমত খেয়ে চোখের পলকে নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, “সোনা কতটা?”
“ওসব আমি জানি না।”
“পাথরটা ঝুটো না আসল?”
“তাও জানি না। তবে বহু পুরনো আমলের আংটি, জিনিসটা ভালই হওয়ার কথা।”
ষষ্ঠী একটু গলা-খাঁকারি দিয়ে বলল, “কথাটা পাঁচ কান করবেন না। আমার হাতে ভাল লোক আছে। বিকেলের দিকে ছটা নাগাত আমবাগানের ঈশেন কোণে চলে আসুন। আমি থাকব। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
ছেলেটা ফের ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। তারপর ধীর পায়ে চলে গেল।
যষ্ঠীর বুকটা উত্তেজনায় ধড়ফড় করতে লেগেছে। আংটি যে আসল জিনিস দিয়ে তৈরি, তা সে খুব জানে। পাথরটাও হিরে হওয়াই সম্ভব। অবশ্য ছেলেটাকে সে সব জানানো হবে না। চেপেচুপে বলতে হবে। তবে এরকম একটা হাঁদা-গঙ্গারামকে ঠকানো খুব একটা শক্ত কাজও হবে বলে মনে হল না ষষ্ঠীর মনের আনন্দে সে গুনগুন করে রামপ্রসাদী গাইতে লাগল, আমায় দাও মা তবিলদারি…
হঠাৎ গান থামিয়ে সে ভাবল, নাঃ, ব্যাপারটা একটু দেখতে হচ্ছে। ছোঁকরা রতন বাঁড়ুজ্যের বাড়ি গেল কোন্ মতলবে, তাকে দেখে রতনবাবুর মুখের ভাবখানা কেমন হয়, তার একটা আন্দাজ থাকা দরকার। তাতে কাজের সুবিধে।
ষষ্ঠী উঠে পড়ল এবং হনহন করে হেঁটে আমবাগান ডাইনে রেখে রতনবাবুদের বাড়ির কাছাকাছি এসে একটা বটগাছের পিছন থেকে উঁকি মেরে দেখতে লাগল।
রতন বাঁড়ুজ্যের বাড়ি বিশাল। চারদিকে বাহারি বাগান, মাঝখানে লাল রঙের দোতলা বাড়ি। খিলান গম্বুজ মেলা। গাছপালাও অনেক। বাগানের দেওয়াল ঘেঁষে সারি-সারি শ’দেড়েক নারকোল গাছই আছে। এত দূর থেকে বাড়ির মধ্যে কী ঘটছে তা দেখাই যায় না।
ষষ্ঠী দূর থেকেই খুব উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। তবে এর চেয়ে কাছে এগোতে সে ভরসা পেল না। কেন যে সে রতন বাঁড়ুজ্যেকে এত ভয় পায় তা সে নিজেও জানে না। রতন বাঁড়ুজ্যে ষণ্ডাগুণ্ডা নয়, বরং তাঁকে ধার্মিক ও সজ্জন বলেই সবাই জানে। বয়সও, যথেষ্ট কিছু না হোক,সত্তর তো হবেই। তবু রতন বাঁড়ুজ্যেকে ভয় খায় না বা সমঝে চলে না বা তাঁর চোখে-চোখে তাকায়, এমন লোক এ-তল্লাটে নেই। গুণ্ডা বদমাশ চোর ডাকাত কেউই তাঁকে ঘাঁটাতে সাহস পায় না।
আসল কথা হল রতন বাঁড়ুজ্যের চোখ। অমন রক্ত-জলকরা ঠাণ্ডা চোখ ষষ্ঠী জন্মে দেখেনি। চোখের নজর যেন শরীর ফুটো করে ভিতর অবধি দেখতে পায়। তার ওপর রতন বাঁড়ুজ্যে খুবই কম কথার মানুষ। মুখোনা সবসময়েই কেমন যেন গেরামভারি গোছের। ভাল মন্দ যাই হোক, লোকটাকে অগ্রাহ্যি করার উপায় নেই কারও।
নাঃ, উঁকিঝুঁকি মেরে কোনও লাভ হল না। ফটক আর সদর-দরজার মুখটা গাছপালায় ঢাকা। ষষ্ঠী সুতরাং একটা হাই তুলে রণে ভঙ্গ দিল। আমবাগানটা এবার এক মারোয়াড়ি ইজারা নিয়েছে। আসল বেনারসি ল্যাংড়া পাকতে এখনও দেরি আছে। রাবণের মতো চেহারার দু-দুটো চৌকিদার খাঁটিয়া পেতে বসে বাগান চৌকি দিচ্ছে। ষষ্ঠী তাদের সঙ্গে ভাব জমাতে কয়েকবার চেষ্টা করে দেখেছে, মোটে পাত্তা দেয় না।