সঙ্গে সঙ্গে পাঁচু একটা চমৎকার পেতলের কারুকাজ করা মাঝারি মাপের বাক্স অতি কষ্টে বয়ে ঘরে নিয়ে এল এবং মেঝের ওপর রেখে নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রতনবাবু ডালাটা তুলে ধরতেই গন্ধর্বের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। তারপর প্রসন্নতায় ভরে গেল তার মুখ।
শ্বেত দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “তবু এ বাক্সের শ্রেষ্ঠ সম্পদটিই নেই রতনবাবু। আপনি ভালই জানেন ওই আংটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই বংশের ভাগ্য।”
“জানি। কিংবদন্তি তাই বলে।”
শ্বেত গন্ধর্বের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “কুমার, এখানে আপনার আর কালক্ষেপের প্রয়োজন নেই। লোহিত আপনার পেটিকা বহন করে নিয়ে যাবে। শহরের বাইরে আপনার জন্য একটি দ্রুতগামী যান প্রস্তুত রয়েছে। আপনি যাত্রা করুন। আমি সামান্য একটি কর্তব্য সেরেই আসছি। অনেক দিনের পুরনো একটা ঋণ শোধ করতে হবে।”
গন্ধর্ব কোনও কথা বলল না। তবে তার দুটি সুন্দর আয়ত চোখে একবার রতনবাবু এবং আর একবার খেতের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকিয়ে দেখল।
লোহিত এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। এবার পেটিকাটি একটা কাপড়ে মুড়ে কাঁধে তুলে নিয়ে বলল, “চলুন কুমার। দেরি হলে চলবে না। পথ অনেক।”
গন্ধর্ব মাথা নাড়ল।
ঘরে যখন এই নাটক চলছে, তখন জানালার বাইরে কলাবতীঝোঁপের মধ্যে বসে-থাকা ষষ্ঠীর চোখে পলক পড়ছিল না। পেতলের বাক্সের ভিতরটা সে দূর থেকে দেখেছে। যা দেখেছে তাতে তার চোখ এমন ধাঁধিয়ে গেছে যে, সে আর চোখের পাতা ফেলতেই পারছে না। এত দামি জিনিস কালী-স্যাকরাও সাতজন্মে দেখেনি। ওই পুঁচকে ছোঁড়াটা ওই অত সব সোনাদানা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কালীদার কয়েক লাখ টাকা। টিকের দশ হাজার। সেই সঙ্গে ষষ্ঠীর পাঁচশো।
উত্তেজনায়, রাগে ষষ্ঠীর গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যেতে লাগল।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে যাচ্ছিল ষষ্ঠী, ঠিক এই সময়ে কে যেন কাঁক করে ঘাড়টা চেপে ধরল। আর সেই সঙ্গে আর একখানা হাত এসে চাপা দিল তার মুখে।
অন্ধকারে দেখতে পেল না ষষ্ঠী, তবে যেই হোক তার গায়ে বেশ জোর আছে। অসুরের জোর। ষষ্ঠীকে ওই অবস্থায় প্রায় শূন্যে তুলে এক ঝটকায় অনেকটা দূরে নিয়ে এনে ফেলল।.
জায়গাটা নির্জন। চারদিকে কাঁটাঝোঁপ। “তুই ষষ্ঠী-চোর না?”
ষষ্ঠী দেখল, সামনে রতনবাবুর ছোট ছেলে বিরু দাঁড়িয়ে। ষষ্ঠী এই ছোঁকরাকে একটু ভয় খায়। ভারী গেরামভারী, রাগ রাগ চেহারা। একটু গুণ্ডাপ্রকৃতিরও বটে। পাশে আবার ফিচেল ভাইপো হাবুলটাও দাঁড়িয়ে আছে।
ষষ্ঠী মাথা নুইয়ে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে আপনাদের বাড়িতে আমার চুরি করতে আসা নয়। ওই যে গন্ধর্ব না কি ওই ছোঁড়া, সে আজ আমাদের কী সর্বনাশ করেছে তা যদি শুনতেন! একেবারে সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছে। রাজপুত্তুর না কী যেন শুনলাম। ছ্যাঃ ছ্যাঃ, ওই ফদি রাজপুত্তুর হয় তো তার চেয়ে আমাদের মতো চোর-ছ্যাঁচড় ভাল।”
বিরু ষষ্ঠীকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “বেশি সময় নেই। যা ঘটেছে তা ঠিক পাঁচ মিনিটে বলে ফেল। আমি ঘড়ি দেখছি।”
পুরো পাঁচ মিনিটও লাগল না। চার মিনিট তিপ্পান্ন সেকেণ্ডে ষষ্ঠী সব বলে ফেলল। কিছু বাকি রাখল না।
বিরু ষষ্ঠীর দিকে চেয়ে বলল, “এবার যা করতে বলব তা ঠিক-ঠিক করবি। একটু এদিক-ওদিক করিস না। যদি করতে না পারিস তবে এই এলাকা থেকে একেবারে দূর করে দেব। বুঝেছিস?”
তার চেয়ে আমাকটা ঝাঁকুনি দিয়ে আমি ঘড়ি দেখকেণ্ডে ষষ্ঠী সব ষষ্ঠী বুঝে গেছে। এও বুঝেছে ওই ছোঁকরার সঙ্গে টক্কর দেওয়া তার একার কম্ম নয়। তবে বিরুবাবুর কথা বলা যায় না। সে মাথা নেড়ে বলল, “গরিবের প্রাণটা যাতে না যায় সেটা একটু দেখবেন তো?”
বিরু বলল, “প্রাণ যাবে না। এখন মন দিয়ে শোন। ভুল করিস না…”
.
পেতলের বাক্সটা মন-খানেকের ওপর ভারী। এই ভারী বাক্স টানতে লোহিতের অবশ্য তেমন কোনও কষ্ট হচ্ছিল না। বয়স সত্তর হলেও তার শরীর পালোয়ানের মতো! দু’খানা হাত যেন দু’খানা লোহার মুগুর।
তবে বাক্সটা বারবার কাঁধ বদলে বহন করতে হচ্ছে। প্রচণ্ড গরম বলে ঘামও হচ্ছে তার। বেশি জোরে হাঁটা সম্ভব হচ্ছে না। পথও অনেকখানি।
খুব ধীরে-ধীরে হেঁটে গন্ধর্ব আর লোহিত আমবাগানের ছায়ায় ঢুকল। গন্ধর্বের হাতে টর্চ। মাঝে-মাঝে আলো ফেলছে পথ দেখার জন্য। কেউ কোনও কথা বলছে না।
হঠাৎ পিছন থেকে খুব বিনীত কণ্ঠে কে যেন বলে উঠল, “তা কুমারবাহাদুর কি চললেন?”
গন্ধর্ব চিতাবাঘের মতো ঘুরে দাঁড়াল। টর্চের আলো গিয়ে পড়ল ষষ্ঠীর বিগলিত মুখে। চোখ মিটমিট করে তো-হাসি হাসছে। কুঁজো হয়ে দু’হাত কচলে ভারী বিনয়ী ভাবভঙ্গি করছে সে।
গন্ধর্ব ব্যঙ্গের স্বরে বলল, “আরে কানাইবাবু! একটু আগে যে আপনাকে বাড়ি রওনা করে দিয়ে গেলাম! চোর-ছ্যাঁচড়ের উৎপাতের কথা বলছিলেন যে!”
ষষ্ঠী খুব বিগলিত হেসে বলল, “আজ্ঞে মনটা কেমন উড়ুউড়ু করছিল তখন থেকে। ভাবছিলাম আপনার মতো এত বড় একজন গুণী লোককে কাছে পেয়েও কিছু শিখে না নিলে খুবই লোকসান হবে। এত বিদ্যে, এত নিখুঁত হাতসাফাই,এসব আর এ তল্লাটে কে শেখাবে বলুন। এসব ভেবে ঘরে গিয়েও তিষ্ঠোতে পারলাম না। ভাবলাম, যাই, কুমারবাহাদুরের দোরগোড়ায় গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকি। এই যাওয়ার পথেই আপনার সঙ্গে দেখাটা হয়ে গেল। তা কোথায় চললেন আজ্ঞে?”