“আজ্ঞে হ্যাঁ, যদি অনুমতি করেন।”
“আর এক দণ্ডও আপনার বাড়ির বাইরে থাকা উচিত নয়। যান, তাড়াতাড়ি বরং একটু জোর–পায়েই চলে যান।”
বলতে বলতে ছেলেটা এগিয়ে এসে ষষ্ঠীর ঘাড়ে বন্ধুর মতো হাত রেখে, কিন্তু বেশ একটু চাপ দিয়ে ষষ্ঠীকে ঠেলে দিল। ওইটুকু চাপেই ষষ্ঠীর দম বেরিয়ে চোখ ডেলা পাকিয়ে উঠল ব্যথায়। ছোঁকরার হাতে যেমন বাঘের জোর তেমনি আঙুলেও ভেলকিবাজি আছে। রগ, শিরা, হাড়ের জোড় বুঝে গিয়ে মোক্ষম জায়গায় মোলায়েম করে চাপ দিয়ে প্রাণখানা টেনে বার করে দেয় আর কি।
ষষ্ঠী একবার “আঁক” শব্দ করেই বেশ দৌড়-পায়েই পালাল।
কিন্তু তার নাম ষষ্ঠীচরণ। আজ তার বড় অপমান গেছে। ছোঁকরাটা তিন-তিনবার তাকে ঘোল খাইয়েছে। টিকে অপমান করেছে না-হোক দু’বার। এর একটা পালটি না নিলে নিজের কাছেই তার ইজ্জত থাকে না। তার ওপর নিজের জহুরির চোখ দিয়ে টর্চের আলোয় ছোঁকরার আঙুলের আংটিখানা সে একঝলক দেখে নিয়েছে। সেই আংটিটাই। দিব্যি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ষষ্ঠী তাই পালিয়েও পালাল না। বিশাল আমবাগান, দেদার গাছ, অমাবস্যার ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। কে কার ওপর নজর রাখবে। ষষ্ঠী একটা নধর গাছের গোড়ায় ভোজালি দিয়ে নিপুণ হাতে একটা গর্ত খুঁড়ে লোটাদুটো পুঁতে রাখল। তারপর বানরের মতো গাছ বেয়ে উঠে একটা বেশ হেলানো ডালে পা ঝুলিয়ে বসল। তার মন বলছে, একটা ঘটনা কিছু ঘটতে চলেছে। সে গন্ধ পায়।
০৯. গন্ধর্ব তার ঘরে নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে
গন্ধর্ব তার ঘরে নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে। রাত্রি গভীর। চারদিক খুবই নিস্তব্ধ।
এমন সময়ে দরজায় মৃদু টোকা পড়ল। “গন্ধর্ব! গন্ধর্ব! ওঠো।”
গন্ধর্ব চোখ মেলল। চকিতে উঠে বসল। চারদিকে বিদ্যুৎগতিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে খাট থেকে নামল।
দরজা খুলতেই তার ঘুমকাতর চোখ একটু বিস্ফারিত হয়ে গেল। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছেন রতনবাবু এবং তাঁর পিছনে দু’জন বিকট চেহারার সন্ন্যাসী।
রতনবাবু মৃদুস্বরে বললেন, “গন্ধর্ব, এরা শ্বেত আর লোহিত। তোমার দাদুর বিশ্বস্ত দুই সহচর।”
গন্ধর্ব একটা হাই চাপল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, “শ্বেত আর লোহিত! শ্বেত আর লোহিত…”
বলতে বলতেই তার চোখের ধোঁয়াটে ভাব কেটে উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল। মুখে দেখা দিল হাসি। সে বলল, “হ্যাঁ, শ্বেত আর লোহিতের কথা দাদুর কাছে শুনেছি। আপনারা ঘরে আসুন।”
ঘরে ঢোকার পর উজ্জ্বল আলোয় সন্ন্যাসী দু’জনকে ভাল করে দেখল গন্ধর্ব। দু’জনের চেহারাই হুবহু একরকম। একই উচ্চতা, একই স্বাস্থ্য, একই রকম নাক চোখ মুখ। শুধু একজনের গায়ের রং ফর্সা, অন্যজনেরটা একটু তামাটে। দু’জন সন্ন্যাসীই অত্যন্ত কুটিল ও ঘোর সন্দিহান চোখে তাকে নিরীক্ষণ করছিল। মুখে কথা নেই।
শ্বেত এক পা এগিয়ে এসে খুব সটান হয়ে দাঁড়িয়ে তার চোখে দুই ভয়ংকর চোখ রেখে বলল, “বৈশাখী অমাবস্যা অবসানপ্রায়। আগামী পূর্ণিমায় অভিষেক। শুরু হোক দিগ্বিজয়। এবার আপনার সংকেতবাক্য বলুন।”
গন্ধর্ব মৃদু একটু হেসে বলল, “জলে অমৃত, বায়ুতে অমৃত, রৌদ্রে অমৃত।”
শ্বেত সহর্ষ বজ্রধ্বনিতে বলে উঠল, “সাধু। এবার আপনার অঙ্গুরীয় প্রদর্শন করুন।”
গন্ধর্ব তার হাত বাড়িয়ে দিল। অনামিকায় ঝকঝক করছে আংটি।
শ্বেত আর একবার বজ্রনিনাদে বলল, “সাধু। রাজা রামদুলালের বংশরক্ষাকারী কুমার গন্ধর্বের জয় হোক। আমরা আপনার ভৃত্য, আমাদের বংশধরেরাও আপনার এবং আপনার বংশধরদের আজ্ঞাবাহী হয়ে থাকবে।”
গন্ধর্ব হাত তুলে রাজকীয় ভঙ্গিতে বলল, “শুভ।”
শ্বেত এবার গন্ধর্বকে নিচু হয়ে প্রণাম করে রতনবাবুর দিকে ফিরে তাকাল। মৃদু গম্ভীর স্বরে বলল, “কুমার গন্ধর্বনারায়ণ যথাসময়ে আপনার কাছে উপস্থিত হয়ে শর্ত পালন করেছে।”
রতনবাবু অবিচলিত গলায় বললেন, “হ্যাঁ।”
“সাধু। শর্ত ছিল গন্ধর্বনারায়ণ যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে তার সম্পত্তি দাবি করলে সবই আপনি ফিরিয়ে দেবেন।”
“হ্যাঁ।”
“সাধু। এবার আপনার কাছে গচ্ছিত সম্পত্তির প্রতিভূ হিসেবে অঙ্গুরীয় প্রদর্শন করুন। আমরা দুটো আংটি মিলিয়ে দেখব।”
রতনবাবু অবিচলিত স্বরে বললেন, “আংটি চুরি গেছে।” ঘরের মধ্যে বজ্রপাত ঘটলেও যেন এর চেয়ে বেশি হতবাক কেউ হত। কয়েক সেকেণ্ড ঘরে এমন নিস্তব্ধতা নেমে এল যে, এ ওর হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল।
নীরবতা ভাঙল শ্বেত। মন্দ্রস্বরে সে বলল, “চুরি! আংটি চুরি যাওয়ার দণ্ডের কথা আপনি বিস্মৃত হননি তো!”
রতনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “না।”
শ্বেত একটু হাসল। তারপর চাপা হিংস্র স্বরে বলল, “সাধু। এসব সম্পত্তি, এই বাড়ি এবং অন্যান্য যা আছে তার দলিল কার নামে রতনবাবু?”
রতনবাবু পিছন দিকে হাত বাড়াতেই দরজার ওপাশ থেকে পাঁচুর প্রেতসদৃশ একখানা হাত এগিয়ে এল। একতাড়া দলিল-দস্তাবেজ বাণ্ডিলে বাঁধা।
বনবাবু বাণ্ডিলটা খেতের হাতে দিয়ে বললেন, “রামদুলাল রায়কে সম্পত্তি একটু হাসলড়ৈ বললেন, ‘কথা দিয়েছিলাম যে, সব সম্পত্তিই তার নাতির নামে হবে। একজিকিউটার আমি। সব সম্পত্তিই তাই নাবালক গন্ধর্বের নামেই রয়েছে। এতকাল আমি সেই সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও ভোগ-দখল করেছি। কিন্তু এই সম্পত্তির পরিমাণ সামান্যই। গন্ধর্বের জন্য গচ্ছিত আছে এক বাক্স ভর্তি মোহর, মূল্যবান পাথর, নানারকম অলঙ্কার। তার দাম বহু লক্ষ টাকা। ব্যাঙ্কের লকার থেকে আমি তা তুলে এনে রেখেছি। পাঁচু!”