তবে যদি কোনওরকমে কাজটা হাসিল করে ফেলতে পারে ষষ্ঠী, তবে এক রাতেই সে রাজা হয়ে যাবে। কালী স্যাকরার কয়েক লাখ টাকা আর সোনার গয়না, লাখ টাকার হিরের আংটি মিলিয়ে যা হবে তা কল্পনাও করা যায় না। একটা নয়, দুটো ডাকাতের দল খুলবে ষষ্ঠী। একশোটা বন্দুক কিনে ফেলবে। রোজ শুধু পোলাও কালিয়া খাবে। বারোটা গামছা কিনবে। দুটো গাই-গোরু। একটা মোটরগাড়ি। একটা পাহাড়। একটা জাহাজ…
ভাবতে ভাবতে চোখ চকচক করতে লাগল ষষ্ঠীর। বিড়বিড় করে বলল, “জয় মা কালী। বুকে সাহস দে মা। মাথায় বুদ্ধি দে মা। গায়ে জোর দে মা।”
বলে ষষ্ঠী কালী স্যাকরার দোকান থেকে বেরিয়ে হনহন করে হেঁটে বাঁশবন পেরিয়ে শর্টকাট ধরে আমবাগানে এসে ঢুকল।
হঠাৎ একটা ক্রুদ্ধ ‘গর আওয়াজ পেয়েই ষষ্ঠী একলাফে নিচু একটা গাছের ডাল ধরে ঝুল খেয়ে ভোজালি সমেত ঝটপট গাছে উঠে পড়ল। ৫৬
বুকে ধাঁই-ধপাধপ শব্দ হচ্ছে। এই আমবাগানে বাঘ থাকার কথা নয়। তবে এল কোত্থেকে?
তবে কিনা ষষ্ঠীর পাকা কান। একটু শুনেই বুঝল, বাঘ নয়। নাক ডাকছে।
সাহসে ভর করে ষষ্ঠী নেমে এসে দরোয়ানদের ঝোঁপড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল দুই মুশকো ভোজপুরী মাটিতে কুমড়ো-গড়াগড়ি খেয়ে ঘুমোচ্ছে। নাকের কী ডাক রে বাবা!
ষষ্ঠী খুব আহ্বাদের সঙ্গে ফিকফিক করে হাসল। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই। এই দুটো দরোয়ান প্রায়ই রাতবিরেতে “কে রে? কৌন হ্যাঁয় রে?” বলে এমন চেঁচায় যে, ষষ্ঠীর পিলে চমকে যায়। একবার তো একজনের লাঠি খেতে খেতে দৌড়ে পালিয়ে কোনওরকমে বেঁচে গিয়েছিল সে। দু’জনের সামনে দুটো লোটা দেখে ষষ্ঠী আর লোভ সামলাতে পারল না। তুলে নিল। পুকুরে ডুবিয়ে দেবে। পরে তুলে নিলেই হবে।
মা লক্ষ্মী এভাবেই তো দেন। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা কি ঠিক? এক হাতে দুটো লোটা আর অন্য হাতে ভোজালিটা বাগিয়ে ধরে ষষ্ঠী ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে রতন বাঁড়ুজ্যের বাড়ির দিকে এগোল। পথেই পুকুরটা পড়বে।
বেশ নিশ্চিন্ত মনেই এগোচ্ছিল ষষ্ঠী। মনটায় একটু স্ফুর্তিও আছে। ধর্মের কল যে বাতাসে নড়ে তা এই একটু আগে নিজের চোখেই দেখেছে ষষ্ঠী। তার মনে হচ্ছে ভগবান যখন এতটাই দেখলেন, আর একটু কি দেখবেন না? ওই এঁচোড়ে-পাকা ছোঁড়াটার কাছ থেকে হিরের আংটি সমেত কালীদার চুরি-যাওয়া গয়না আর টাকা হাতাতে পারলে তাকে আর পায় কে?
কিন্তু একটা খটকাও লাগছে ষষ্ঠীর। ছোঁড়াটা যখন ঘুমোচ্ছিল তখন সে নিজে হাতে ঘরের মধ্যে ঘুমের ওষুধ স্প্রে করেছে। সে এমনই তেজালো ওষুধ যে হাতিরও সে ঘুম সহজে ভাঙার কথা নয়। কিন্তু ছোঁকরা সেই ওষুধের ক্রিয়া এমন চট করে কাটিয়ে উঠল কী করে? তার ওপর তারা দু’ দুটো হুমদো তোক বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢোকার পরও রতন বাঁড়ুজ্যের বাঘা কুকুরটা একবারও ডাকল না কেন?
ষষ্ঠী আমবাগান পার হয়ে ফাঁকা জমিতে পা রাখতেই মুখে ঝপাস করে একটা টর্চের আলো এসে পড়ল।
“আরে! কানাইবাবু যে?”
গলার স্বরটা এক লহমায় চিনে ষষ্ঠী খুব বিনয়ের সঙ্গে একটু হাসল, “হেঃ হেঃ, এই একটু ঘুরে-টুরে দেখছি আর কি। বড্ড গরম কিনা ঘরে।”
“তা ভাল। তবে হাতে ও দুটো কী? পেতলের ঘটি দেখছি…!”
ষষ্ঠী শশব্যস্তে বলল, “আর বলবেন না, লোকের বড় ভুলো মন হয়েছে আজকাল। কে যেন ফেলে গেছে আমবাগানে। হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম পুকুরে ফেলে দিয়ে আসি।”
“কিন্তু কানাইবাবু, আপনার ডান হাতে একটা ভোজালিও দেখছি না?”
ষষ্ঠী জিব কাটল। তারপর অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ভোজালিটার দিকে একটু চেয়ে থেকে চোখ মিটমিট করতে করতে বিগলিত মুখে বলল, “আজ্ঞে, আমিও দেখছি। কিন্তু কোত্থেকে যে জিনিসটা এল, তা বুঝতে পারছি না। এই ছোরা-টোরা খুব খারাপ জিনিস, আমি লোককে সেকথা বলিও।”
টর্চের আলোয় তাকে আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিয়ে ছোঁকরাটা বলল, “ছোরায় সব সময় কাজও হয় না। তাই না?”
ষষ্ঠী বিগলিত মুখে বলল, “আজ্ঞে, সে আর বলতে?”
“কিন্তু আপনার কপালটা যে বেশ ফুলে আছে কানাইবাবু? পড়ে-উড়ে যাননি তো?”
ষষ্ঠী খুবই উদার স্বরে বলল, “সে আর বিচিত্র কী? কোথাও অন্ধকারে ঢুসোটুসো লেগে থাকবে। তবে আমার এ আর কী দেখছেন? অন্যদের আরও কত হয়ে আছে তার হিসেব কে জানে।”
“তা বটে।” বলে ছোঁকরা একটু হাসল। তারপর টর্চের আলোটা নিবিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি বেশ ভাল লোক কানাইবাবু। এ অঞ্চলে আমি আর আপনার চেয়ে ভাল লোক দেখিনি।”
“আজ্ঞে কথাটা আমারও মাঝে-মাঝে মনে হয়। একটু-আধটু যা করে ফেলি তা ওই কুসঙ্গে পড়ে।”
“তা বটে। আপনার ওই স্যাকরা লোকটিও বেশ ভাল। আমার তো ধারণা ছিল আংটিটার জন্য পঞ্চাশ টাকাও পাব না। কিন্তু স্যাকরার দয়ার শরীর বলে আমার দুর্দশা দেখে চারশো টাকা দিয়েছেন। ভারী ভাল লোক কালী-স্যাকরা। এখানে দেখছি ভাল লোকের সংখ্যাই বেশি।”
এই কথায় ষষ্ঠী একটু বিনয় দেখাতে গিয়ে মাথা হেঁট করে ঘাড় চুলকোতে গেল। বে-খেয়ালে ভোজালিসুষ্ঠু হাত ঘাড়ে তুলে জিব কেটে হাতটা তাড়াতাড়ি নামিয়ে বলল, “যে আজ্ঞে। তা হলে এবার আমি আসি গিয়ে। বাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে। ইদিকে বড় চোর-ছ্যাঁচড়ের উপদ্রব কিনা।”
“চোর-ছ্যাঁচড়ও আছে নাকি এখানে? ওরে বাবা, তা হলে তো আপনার এক্ষুনি বাড়ি যাওয়া উচিত।”