কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে আবার চোখ খুলে সে দেখল, টিকে এখনও গন্ধমাদনের মতো পড়ে আছে সামনে। দেখে ফিক করে একটু হেসে ফেলল ষষ্ঠী। তার মোটে পাঁচশো, টিকের গেছে দশ হাজার। উচিত শিক্ষা হয়েছে। ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন। কপালের ফের না হলে টিকের যাওয়ার কথা পাঁচশো, আর ষষ্ঠীর দশ
হাজার।
দশ হাজার তার ট্র্যাক থেকে গেলে ষষ্ঠী শোকে আর উঠে দাঁড়াতে পারত না।
পাঁচশোর শোক অনেক কম। ষষ্ঠী তাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল, গন্ধমাদনটার দিকে তাকিয়ে আবার ফিকফিক করে হাসল সে। পাগলবেশী ডাকাতটা টিকে-কে একটা ল্যাং আর একটা বিরাশি সিক্কার রদ্দা কষিয়েছে। সেই তুলনায় ষষ্ঠীর ভাগে পড়েছে মাত্র একটা গাঁট্টা, ভগবানই চিরকাল গরিবকে দেখেন।
নিজের কপালের ট্যামটায় একটু হাত বোলাল ষষ্ঠী। তারপর টিকের টাকা হাতিয়ে দেখল। দেখে রাখা ভাল। টাকাটা যে সত্যিই গেছে সে-বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ষষ্ঠী টিকের কোমর থেকে ভোজালিখানা খুলে নিল। সাবধানের মার নেই।
তারপর ষষ্ঠী বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “বিশ্বাসঘাতক! শয়তান!” বলে ক্যাঁত ক্যাঁত করে কয়েকটা লাথি কষাল টিকের কোমরে। টিকে অবশ্য লাথি-টাথি টের পেল না। তবে একবার গোঙানির শব্দ করে উঠতেই ষষ্ঠী দু’ পা পিছিয়ে এল সভয়ে। দূর থেকেই আরও কিছুক্ষণ টিকের উদ্দেশে গালমন্দ বর্ষণ করে সে রণে ভঙ্গ দিল। আংটি গেছে, টাকা গেছে, তবু ষষ্ঠীর একরকম আনন্দই হচ্ছিল। তার মোটে পাঁচশো গেছে, কপালে মাত্র একটা ছোট্ট ট্যাম। আর টিকেটার গেছে দশ হাজার, হাঁটুতে ল্যাং, ঘাড়ে রদ্দা। ওঃ, যা আনন্দ হচ্ছে ষষ্ঠীর!
একটু জিরিয়ে এক ঢোঁক জল খাবে বলে ষষ্ঠী আবার কালী স্যাকরার দোকানে ফিরে এল। স্যাকরার পো আংটিটা জোর দাঁও মেরেছে। রাত জেগে বসে সোনা গলাচ্ছে নিশ্চয়ই।
ষষ্ঠী মৃদু স্বরে ডাকল, “কালীদা! ও কালীদা! ওঃ, যা হুজ্জোতটাই গেল। দেখগে গন্ধমাদনটা কেমন দাঁত ছরকুটে পড়ে আছে গলির মাথায়। হিঃ হিঃ…”
কিন্তু কালী স্যাকরার বন্ধ ঘর থেকে কোনও জবাব এল না। ষষ্ঠী দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। সন্তর্পণে ঘরে ঢুকল ষষ্ঠী। তারপর হাঁ হয়ে গেল। কালী স্যাকরা কেতরে পড়ে আছে মেঝেয়। আংটি হাওয়া। গুপ্ত সিন্দুক হাঁহাঁ করছে।
জিব দিয়ে একটু চুকচুক করে আফসোসের শব্দ করল ষষ্ঠী। এঃ, কালীদাকে একেবারে ফর্সা করে দিয়ে গেছে! গুপ্ত সিন্দুকের খবরটা আগে জানত না ষষ্ঠী। আজ রাতেই প্রথম দেখল, যখন কালী তাদের টাকা বের করে দিল।
ষষ্ঠী আপনমনেই বলল, “দুঃখটা কেন হয়েছ জানো কালীদা? নিল তো একটা অজ্ঞাতকুলশীল নিয়ে গেল সব। এ কাজ তো আমারই করা উচিত ছিল। এঃ, টাকায় গয়নায় হিরের আংটিতে কয়েক লাখ বেরিয়ে গেল গো!”
দুঃখ করতে করতে আবার একটা খুশি-খুশি ভাবও এসে পড়ল ষষ্ঠীর। কালী স্যাকরা তার বন্ধু লোক হলে কী হয়, এক নম্বরের হাড়কেল্পন। হাজার টাকার মাল নিয়ে দুশো টাকা ঠেকায়। লোকটা ঠকবাজ, জোচ্চোর তো বটেই, বাটপাড় বললে কম বলা হয়। পাপে দুনিয়াটাই ভরে গেল। কলিকাল আর বলে কাকে!
তা ভগবান সাজাটাও দিলেন বড় কম নয়। কথায় বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ভাবতে-ভাবতে ষষ্ঠী ফিক করে হেসে ফেলল। কালী স্যাকরার মাজা নির্ঘাত মচকেছে। চোখের নীচে কালশিটে। কপাল ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। পাপের শাস্তি।
ষষ্ঠী খুব আদরের সঙ্গে নিজের কপালের ট্যামটাতে হাত বোলাল। তার কপালে মোটে একটা ট্যাম! তাও খুব বেশি হলে একটা সুপুরির সাইজ। আর ট্যাঁক থেকে গেছে মোটে পাঁচশো টাকা। ছোট পাপের ঘোট শাস্তি। আর কালীদাকে দ্যাখো।
ফিকফিক করে কিছুক্ষণ খুব হাসল ষষ্ঠী।
তারপর হাসি থামিয়ে ষষ্ঠী খুব তাড়াতাড়ি ঘরটা খুঁজে দেখে নিল, নাঃ, কিছু নেই। পাগলটা সব নিয়ে গেছে।
পাগল! আরে, এতক্ষণে পাগলটার কথাই তো সে ভাল করে ভেবে দেখেনি! ষষ্ঠী খুব মন দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে দৃশ্যটা মনে করার চেষ্টা করল। একটা পাগল গলির মুখে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছিল আর. আপনমনে হাসছিল।
হ্যাঁ, ষষ্ঠী এবার পরিষ্কার পাগলটাকে মনে করতে পারল। অন্ধকার
ছিল বটে, কিন্তু পাগলটা কতটা লম্বা, হাত-পায়ের গড়ন কীরকম, নড়াচড়া কীরকম, এগুলোর একটু আন্দাজ পেয়েছিল সে। আর আশ্চর্যের বিষয়, পাগলটাকে তার খুব চেনা লাগছে। খুব চেনা-চেনা।
হুঁ হুঁ বাবা, ষষ্ঠীর চোখকে ফাঁকি দেবে, এমন এলেম তোমার পেটে নেই। একটু ভাবতেই ষষ্ঠী ধরে ফেলেছে লোকটা কে। কিন্তু সে ভেবে অবাক হল, এতখানি বয়সে সে নিজে আজও যে-বিদ্যে বাগাতে পারেনি, ওইটুকু একরত্তি ছেলে এর মধ্যেই এত শিখে ফেলল কী করে? ষষ্ঠী নিজে পাকা চোর, টিকে দুর্দান্ত গুণ্ডা, কালী স্যাকরা শেয়ালের মতো ধুরন্ধর। অথচ এই তিনজনকে একই দিনে দু দুবার ঘোল খাইয়ে গেল ওই দুধের খোকা?
ভাবতে ভাবতে লজ্জায় ঘেন্নায় শরীরটা শক্ত হয়ে গেল ষষ্ঠীর। মান-ইজ্জত সবই গেল তার। এর একটা বিহিত না করলেই নয়।
শক্ত করে ভোজালিটা চেপে ধরে ষষ্ঠী আরও খানিকক্ষণ ভাবল। কাজটা শক্ত সন্দেহ নেই। একে রতন বাঁড়ুজ্যের বাড়িতে দ্বিতীয়বার ঢোকা। তার ওপর ওই তুখোড় ছোঁকরার সঙ্গে গায়ের জোর, বুদ্ধি আর বদমাইসিতে পাল্লা টানা। কাজটা খুবই শক্ত।