মুখে-চোখে জলের ছিটে দিতেই কালী স্যাকরা অবশ্য চোখ মেলল। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, “ষষ্ঠী, তোর মনে কি এই ছিল রে?”
ষষ্ঠী বিরক্ত হয়ে বলল, “কী হয়েছে বলবে তো?”
“হওয়ার আর বাকি কী রাখলি বাপ? চেয়ে দ্যাখ, আমার এতকাল ধরে তিল তিল করে জমানো টাকা-পয়সা সোনা-দানা সব পাঁচ মিনিটের মধ্যে লোপাট।”
টিকে ধমক দিয়ে বলল, “কী করে লোপাট হল সেটা বলো।”
কাঁদতে কাঁদতে কালী স্যাকরা বলল, “মিনিট দশ-পনেরো আগে ষষ্ঠীর গলা শুনলুম বাইরে থেকে কালীদা, কালীদা’ করে ডাকছে।
উঠে দরজা খুলে দিতেই একটা লোক ঘরে ঢুকে পড়ল। টু শব্দটি করার সময় পেলাম না, একটা রদ্দা বসিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। উঠে দেখছি সব ফসা।”
টিকে ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “ষষ্ঠী লোকটা যে এক নম্বরের বদমাশ সেটা কে না জানে। সুযোগ পেলে নিজের মায়ের গয়নাও ও চুরি করবে। কিন্তু কালীদা, গত দু’ঘন্টায় ষষ্ঠী তোমার দোকানে আসেনি। কারণ ও আমার সঙ্গে ছিল।”
কালী স্যাকরা নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল, “তা হলে সে ষষ্ঠীরই মাসতুতো ভাই হবে। কিন্তু আমি যে ধনেপ্রাণে গেলুম রে!”
ষষ্ঠী হঠাৎ বলল, “না, একেবারে যাওনি। সেই আংটিটা পাওয়া গেছে। যা চুরি গেল, তা সুদে-আসলে তুলে নিতে পারবে।”
দিশেহারা হয়ে কালী স্যাকরা বলল, “আংটি! কই, দেখি!” টিকে ট্যাঁকে হাত রেখে বলল, “কিন্তু ভাগ-বাঁটোয়ারা কেমন হবে সেটা আগে শুনি।”
কালী বলল, “কত চাস?”
“পঞ্চাশ হাজার।”
“ও বাবা, বলিস কী রে ডাকাত? আমার কত গেছে জানিস? লাখ টাকার ওপর। তার ওপর চারশো টাকা আজ সন্ধেতেই ছেলেটার হাতে গুনে দিয়েছি।”
টিকে মাথা নেড়ে বলল, “তোমার যা গেছে তা উসুল করেও আংটির দৌলতে তোমার অনেক থাকবে। আমি পঞ্চাশ হাজার আর ষষ্ঠী পাঁচশো।”
“পাঁচশো!” বলে ষষ্ঠী চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল।
টিকে গম্ভীর ভাবে বলল, “পাঁচশো টাকায় আমাকে দিয়ে খুন করাতে চেয়েছিলি। টিকে তোর কাছে খুব শস্তা হয়েছে, না? পাঁচশো যে তোকে দেওয়া হচ্ছে এই ঢের।”
কালী স্যাকরা হাত বাড়িয়ে বলল, “আংটি যদি খাঁটি হয়, তবে পাঁচ হাজার পাবি, ষষ্ঠী পাবে ওই পাঁচশো। রাজি থাকলে দে।”
দু’পক্ষে তুমুল দরাদরি শুরু হয়ে গেল। আধঘন্টা বাদে সিদ্ধান্ত হল, ষষ্টী পাঁচ শো পাবে, টিকে পাবে দশ হাজার।
টিকে ট্যাঁক থেকে আংটিটা বের করে কালী স্যাকরার হাতে দিয়ে বলল, “এবার দ্যাখো, জিনিস খাঁটি তো?”
কালী স্যাকরা চোখে ঠুলির মতো একটা আতস কাঁচ লাগিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আংটিটা দেখে বলল, “সেইটেই। সন্দেহ নেই। কিন্তু আজ রাতে তো টাকা দিতে পারছি না। আমার যা ছিল এখানে, সব গেছে। তার ওপর এই ঘোর অমাবস্যায় ঘরের টাকা বের করাও পাপ। কাল সকালে এসে টাকা নিয়ে যাস।”
টিকে মাথা নেড়ে বলল, “ও বাবা, তা হবে না। টাকা না পেলে আংটি তোমার কাছে গচ্ছিত রাখে কোন্ মুখ!”
বেজার মুখে উঠে কালী স্যাকরা দেয়ালে লাগানো গুপ্ত সিন্দুক খুলে টাকা বের করে দিয়ে বলল, “এখন বিদেয় হ। আমার অনেক কাজ।”
ষষ্ঠী আর টিকে বেরিয়ে এল। টিকের মুখে হাসি। ষষ্ঠী ধুতির খুঁটে চোখ মুছছে।
আগে-আগে টিকে, পিছনে ষষ্ঠী। সরু অন্ধকার গলিটার মুখে দেয়ালে পিঠ দিয়ে একটা পাগল-গোছের লোক দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছিল। তাকে বিশেষ নজর না করে পেরিয়ে যাচ্ছিল দুজনে।
কিন্তু ঘটনাটি ঘটল বিদ্যুতের বেগে। দুজনে ঠাহরই করতে পারল না যে, কী হল।
টিকে নিশ্চিন্ত মনে হাঁটছিল। তার গায়ে অসুরের জোর, কোমরে ভোজালি, বুকে দুর্জয় সাহস, ট্যাঁকে দশ হাজার গা-গরম করা টাকা। এ-তল্লাটে তাকে ঘাঁটানোর সাহস কারও নেই।
কিন্তু পাগলটা হঠাৎ ঠ্যাং বাড়িয়ে ছোট্ট একটা ল্যাং মারল তাকে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল হাতের চেটোর একটা দুর্জয় কোপ টিকে–দশাসই টিকে একবার মাত্র ‘কোঁক’ শব্দ করে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। আর নড়ল না।
ষষ্ঠী ঘটনাটা বুঝতেই পারেনি। আচমকা টিকে ওরকম গদাম করে পড়ে যাওয়ায় সে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। পাগলটা খুব ধীরেসুস্থে হিসেব-নিকেশ করে তার কপালে একটা ছোট্ট গাঁট্টা মারল। ষষ্ঠী খুব অমায়িকভাবে বসে পড়ল মাটিতে। তারপর চোখ উল্টে গোঁ-গোঁ করতে লাগল।
পাগলটা নিচু হয়ে টিকের ট্যাঁক থেকে দশ হাজার আর ষষ্ঠীর ট্যাঁক থেকে পাঁচশো টাকা বের করে নিল।
জানালা দরজা বন্ধ করে কালী স্যাকরা বাতি জ্বেলে আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। হিরেটা খুলে সোনা গলিয়ে ফেলতে হবে। নইলে
চোরাই জিনিস, ধরা পড়তে কতক্ষণ?
ঠিক এই সময়ে বাইরে থেকে টিকে ডাকল, “কালীদা।”
কালী বিরক্ত হয়ে বলে, “আবার কী চাস?”
টিকে চাপা গলায় বলল, “বলছিলাম কী, আমার বউটা তো ভীষণ দজ্জাল, তুমি জানো।”
“তা জানি।”
“আমি এত রাতে বাড়ি ফিরলে বউ আমার ট্যাঁক হাতিয়ে দেখবে। টাকাটা পেলে নিয়ে নেবে। তাই বলছিলাম, টাকাটা আজ রাতের মতো তোমার কাছে থাক। কাল এক ফাঁকে যখন বউ বাড়িতে থাকবে না, তখন এসে নিয়ে যাব।”
একথায় কালী স্যাকরা খুশি হল। টাকা তার প্রাণ। যতক্ষণ কাছে থাকে, ততক্ষণই মনটা ভাল থাকে। দশ হাজার টাকা হাতছাড়া হওয়ায় মনটা খিচড়ে ছিল এতক্ষণ।
“দাঁড়া, দরজাটা আজ রাতে আর খুলব না। জানালাটা ফাঁক করছি, হাত গলিয়ে দিয়ে দে।”