বিরু নড়েচড়ে বসে বলল, “তা হলে কী করা যায় বলো তো!”
পাঁচু কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে বলল, “কিছু একটা করতেই হবে। চুপচাপ বসে থাকলে তো চলবে না। আংটিচোর যেই হোক, সেও অতি পাকা লোক।”
হাবুল একটু উত্তেজিত গলায় বলল, “আংটি দেখাতে না পারলে ওরা দাদুকে মেরে ফেলবে কেন?”
পাঁচু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেই রকমই কথা হয়েছিল। আংটি হারালে রামদুলালের বংশ লোপাট হয়ে যাবে। আপকালে অন্যের কাছে গচ্ছিত রাখা চলে, কিন্তু চুরি গেলে বা হারালে চলবে না। পাছে লোভে বা অভাবে পড়ে কতামশাই আংটি বেচে দেন বা হারিয়ে ফেলেন, সেই ভয়েই ওরকমধারা শর্ত করা হয়েছিল। তবে,বাপু,খুনখারাপির কথা রামদুলালের মাথায় আসেনি, সে কতামশাইকে বাস্তবিকই বিশ্বাস করুত। খুনের কথা তোলে ওই শ্বেত আর লোহিত। আজ তারা বগল বাজাবে।”
০৬. রাত সাড়ে দশটা নাগাদ
রাত সাড়ে দশটা নাগাদও যখন বাড়িতে কেউ ঘুমোতে গেল না, তখন রতন বাঁড়ুজ্যে তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে ডেকে বললেন, “তোমরা যে যার ঘরে গিয়ে দোর দিয়ে শুয়ে পড়ো। সাড়াশব্দ কোরো না। সব বাতি নিবিয়ে দাও। আজ রাতে আমার কাছে বিশেষ দু’জন অতিথি আসবে, তাদের সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। তা ছাড়া আর একজন বিশেষ অতিথি বাড়িতে আছেন, তিনি যেন ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পান।”
রতন বাঁড়ুজ্যের আদেশ অমান্য করার সাধ্য কারও নেই। সকলেই ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল।
আস্তে-আস্তে অমাবস্যার রাত গম্ভীর হতে লাগল। নিজের ঘরে রতন বাঁড়ুজ্যে আর পাঁচু জেগে অপেক্ষা করতে লাগল।
রাত একটু গাঢ় হল, অন্ধকার আরও ঘুটঘুটি। শেয়াল, এক প্রহরের জানান দিল। রতন বাঁড়ুজ্যের বাড়ির বাগানে কোনও নড়াচড়া নেই কোথাও। শুধু জোনাকি জ্বলে আর ঝিঝি ডাকে অবিরাম।
হঠাৎ আমবাগানের দিক থেকে বেড়ালের মতো একটা ছায়া লাফিয়ে উঠল দেয়ালের ওপর। তারপর আরও একজন। দেয়ালের ওপর উঠে কিছুক্ষণ নিস্পন্দ রইল দুটি ছায়া। চারদিকটা ভাল করে অনুভব করে নিল। তারপর নিঃশব্দে ঝুল খেয়ে নেমে পড়ল বাগানে।
কুকুরটার ডেকে ওঠার কথা। ডাকল না। তেড়েও এল না।
দু’জনে গাছপালার ফাঁক দিয়ে নিঃশব্দে এগোতে লাগল।
উত্তরের ঘরের জানালা খোলা। জানালার নীচে কলাবতীর মস্ত-মস্ত ঝোঁপ। দুটি ছায়া নিঃসাড়ে সেই ঝোঁপের মধ্যে ডুবে গেল।
একটু বাদে অত্যন্ত আস্তে একজন মাথা তুলল। কান পেতে শুনল, ঘরের মধ্যে খাসের আওয়াজ কীরকম হচ্ছে। ঘুমন্ত মানুষের স্বাসের আওয়াজ অন্যরকম হয়।
নিশ্চিন্ত হয়ে লোকটা একটা স্প্রে-গান তুলে ঘরের মধ্যে তীব্র ঘুমের ওষুধ ছড়িয়ে দিল। শ্বাসের শব্দ আস্তে-আস্তে আরও. গাঢ় হয়ে গেল।
জানালায় লোহার শিক, এবং তা বেশ মজবুত। স্প্রে-গান ঝোলার মধ্যে রেখে লোকটা একটা অ্যাসিডের শিশি বের করে দুটো শিকের গোড়ায় ঢেলে দিল একটু-একটু করে। কয়েক মিনিট পর দ্বিতীয় লোকটা দু’হাতের চাপে দুটো শিক দু’দিকে সরিয়ে অনেকটা ফাঁক করে ফেলল।
নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল দুজন। একজন একটা কমজোরি টর্চ জ্বেলে বিছানায় আলো ফেলল। বলল, “ওই তো।”
অন্যজন একটু ঝুঁকে গন্ধর্বের আঙুল থেকে আংটিটা খুলে নিল। চোখের পলকে সেটা ট্যাঁকে খুঁজে সে ঘরের অন্যান্য জিনিসে মন দিল।
ঘরে খুব বেশি কিছু নেই। একটা কাঁসার গ্লাসে জল ঢাকা ছিল। সেটা ঝোলায় পুরল লোকটা।
দ্বিতীয়জন কোমর থেকে একটা ভোজালি বের করে বলল, “বলিস তো এবার খুনটা করে ফেলি।”
ষষ্ঠী চাপা গলায় বলল, “থাকগে, যেতে দাও।”
“তার মানে?”
“চুরি এক জিনিস, খুন অন্য। খুনের আর কোনও দরকারও নেই। আসল জিনিস পেয়ে গেছি।”
“কিন্তু আমার টাকাটা?”
ষষ্ঠী মৃদু একটু হেসে চাপা স্বরে বলল, “পাবে। ও সামান্য টাকা তোমার মারব না। এখন চলো, জায়গামতো জিনিসটা পৌঁছে দিতে হবে।”
দ্বিতীয় লোকটা আর আপত্তি করল না। দু’জনে আবার জানালা দিয়ে বেরিয়ে বাগান পেরিয়ে দেয়াল ডিঙিয়ে বাইরে চলে এল।
ষষ্ঠী হঠাৎ বলল, “কুকুরটা ডাকল না কেন বলো তো! তাজ্জব!”
টিকে বলল, “সেটাই ভাবছিলাম। ওরকম বদমেজাজি কুকুর একদম চুপ মেরে রইল?”
দু’জনে আমবাগানের ছায়ায় গা ঢাকা দিয়ে হেঁটে বাঁশবনের অন্ধকারে ঢুকল। এ-পথে শর্টকাট হয়, রাস্তাও নিরাপদ।
বাঁশবনে একটু গভীরে ঢুকেই টিকে ডাকল, “ষষ্ঠী।”
“চলো টিকেদা।”
“আংটিটা দে।”
“আংটি! আংটি তোমাকে দেব কেন? ও তো বখরার মাল নয়। তোমাকে থোক টাকা দেব বলেছি, ঠিক দেব।”
“আংটি বখরার জিনিস নয় কে বলল? আলবাত বখরার জিনিস। দে।”
ষষ্ঠী দু’পা পিছিয়ে গিয়ে হিংস্র গলায় বলল, “না।”
টিকে এক হাতে ষষ্ঠীর গলাটা টিপে ঘরে অন্য হাতে তাকে একটা পাঁচ কিলো ওজনের চড় কষাল। তারপর তার ট্যাঁক থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে নিজের ট্যাঁকে রেখে বলল, “এবার চল।”
ষষ্ঠী আর গাঁইগুঁই করল না। গালে হাত বোলাতে-বোলাতে টিকের পিছু-পিছু হাঁটতে লাগল।
কালী স্যাকরা জেগে বসে থাকবে, এরকম কথা ছিল। আংটিটা পেলেই সে হিরে খুলে নিয়ে সোনা গলিয়ে ফেলবে।
কিন্তু কার্যত দেখা গেল, কালী স্যাকরা জেগে নেই। ঘর অন্ধকার, দরজাও বন্ধ।
ষষ্ঠী আর টিকে চাপা স্বরে ডাকল, “কালীদা! ও কালীদা!” জবাব নেই। ষষ্ঠী দরজায় ধাক্কা দিল। অমনি কপাট খুলে গেল ঝড়াত করে। ভিতরে ঢুকে দৃশ্য দেখে দুজনেই হাঁ। কালী স্যাকরা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার সিন্দুক খোলা, আলমারি হাঁ-হাঁ করছে। কী হয়েছে তা বুঝতে দু’জনের এক লহমা লাগল।