বিরু মাথা নেড়ে বলল, “না, শুনিনি।”
হাবুল নড়েচড়ে বসল।
পাঁচু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “অত্যন্ত গোপন কথা। এতকাল কাউকে বলার হুকুম ছিল না। আজ বিপদের দিনে বলছি। সেও এক বৈশাখী অমাবস্যার দিন। কতামশাই বিকেলে একটা শাবল দিয়ে বিগ্রহের সিংহাসনের তলায় জমা শ্যাওলা চেঁছে পরিষ্কার করছিলেন। সিংহাসনটা হঠাৎ ঢকঢক করে নড়ে উঠল। তলায় মেঝের ওপর দেখা গেল একটা চৌকোনা ফাটল। কামশাই প্রথমটা ঘাবড়ে গেলেও কাউকে কিছু বললেন না। গভীর রাতে মন্দিরে ঢুকে ফের সেই আড়াইমন ভারী সিংহাসন টেনে সরিয়ে শাবলের চাড় দিয়ে চৌকোনা জায়গাটা ফাঁক করলেন। কাজটা বলতে যত সহজ, কাজে ততটা ছিল না। ভারী পাথরের সেই চাংড়া তুলতে হাতি লাগে।”
হাবুল হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “তুমি তখন কোথায় ছিলে?”
পাঁচু সামান্য একটু হাসল। বলল, “কতামশাইয়ের সঙ্গেই। দুজনে মিলেই ওই কাণ্ড করি। পাথর সরাতেই দেখি নীচে গর্ত। প্রায় সাত হাত গভীর কুয়োর মতো। সেই গর্তের মধ্যে দুটো পেতলের বাক্স। কুলুপ আঁটা। আমরা দুজনেই বুঝতে পারলুম যে, এ হল গুপ্তধন। ইচ্ছে করলেই আমরা সেই দুটো বাক্স রাতারাতি সরিয়ে ফেলতে পারতুম, রামদুলাল টেরও পেত না। গর্ত চাপা দিয়ে সিংহাসনটা জায়গামতো বসিয়ে দিলেই হল। কিন্তু কতামশাই তা হতে দিলেন কই? পরদিন সকালে রামদুলালকে চুপি-চুপি খবরটা দিলেন। সেই থেকে রামদুলালের অবস্থা ফিরে গেল।”
হাবুল বলল, “তোমাদের কিছু দিল না?”
পাঁচু মাথা নেড়ে বলল, “দিয়েছিল, সামান্য কিছু বখশিশ। যা পেয়েছিল, তার তুলনায় কিছুই নয়। সোনাদানা মোহর হিরে জহরত মিলিয়ে সে কোটি টাকা হবে। টাকা পেয়েই বাবুয়ানির মাত্রা বাড়িয়ে দিল রামদুলাল। ঘনঘন ভোজ দিতে লাগল, বাড়ির ভোল পাল্টাল, নতুন গাড়ি কিনল। আর তাই দেখেই শরিকদের মধ্যে গুজগুজ ফুসফুস শুরু হয়ে গেল। লোক তারা বড় ভালও ছিল না। শচীদুলাল ছিল সাক্ষাৎ ডাকাত। যেমন, রাগী, তেমনি নির্দয়। রামদুলাল যে বিশালাক্ষী মন্দিরে বংশগত গুপ্তধন পেয়েছে, একথাটাও চাউর হতে বিশেষ দেরি হয়নি। আমার মনে হয় আহ্লাদে বেহেড হয়ে রামদুলাল নিজেই সেকথা কবুল করেছিল। ফলে শরিকরা দাবি করতে লাগল, গুপ্তধন একা রামদুলালের নয়, ওতে তাদেরও ভাগ আছে। ফলে লেগে গেল বখেরা। ঝগড়া কাজিয়ায় লক্ষ্মণগড় তখন গরম। সেই গরমের মধ্যেই একদিন আর-পাঁচজন শরিকের লোজন নিয়ে শচীদুলাল চড়াও হল রামদুলালের ওপর। রক্তগঙ্গা বয়ে গেল।”
“কেউ বাঁচেনি?”
পাঁচু ফের গামছায় মুখ মুছে বলল, “কতামশাই বুদ্ধিমান লোক। কিছু একটা ঘটবে আঁচ করে নিজের পরিবারকে আগেভাগেই দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম। রামদুলাল তাড়া খেয়ে শুধুমাত্র একটা নাতিকে কোলে নিয়ে পালাতে পেরেছিল।” হাবুল বলল, “তা হলে দাদুকে সম্পত্তি দিয়েছিল কখন?”
পাঁচু গামছা ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে-খেতে বলল, “কতামশাইয়ের মত বিশ্বাসী লোক যে হয় না, তা রামদুলালের চেয়ে ভাল আর কে জানে? একটা পেতলের বাক্স সে কতামশাইয়ের কাছে আগেই গচ্ছিত রেখেছিল। তখনই ওই শর্ত করে রাখে। তবে শর্ত এও ছিল, পঁচিশ বছরের মধ্যেও যদি তার নাতি গিয়ে সম্পত্তি দাবি না করে তবে তা তোমার দাদুর হয়ে যাবে। যখন এই শর্ত হয়, তখন সাক্ষী ছিলুম আমি আর শ্বেত লোহিত নামে দুই যমজ ভাই। রামদুলালও আন্দাজ করেছিল, শরিকরা একদিন চড়াও হতে পারে, তাই আগেভাগেই নিজের ভবিষ্যৎ গোছাতে ওই বাক্সটা কতামশাইয়ের কাছে চালান দেয়। হিরের আংটিটা ছিল ওই বাক্সের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস। একটা ভূর্জপত্রে লেখা ছিল : এই অভিজ্ঞান যেন কখনওই পরহস্তে না যায়। যদি যায়, তা হলে বংশের বাইরের কেউ যেন একমাত্র বৈশাখী অমাবস্যার রাত ছাড়া এই আংটির দিকে না তাকায়। তাকালে সে অন্ধ হয়ে যাবে। অন্য বাজতেও ঠিক ওই রকম একটা আংটি ছিল, যা এখন গন্ধর্বর হাতে রয়েছে।”
হাবুল জিজ্ঞেস করল, “গন্ধর্বদার আংটির দিকে তাকালেও কি চোখ অন্ধ হয়ে যাবে আমাদের?”
পাঁচু মাথা নেড়ে বলল, “না। ওই বংশের কারও হাতে থাকলে আর ভয় নেই।”
বিরু মৃদু হেসে বলল, “এসব কিংবদন্তী হল ফর সিকিউরিটিজ শেক। যাতে কেউ আংটি চুরি করতে সাহস না পায়।” হাবুল বলল, “তারপর কী হয়েছিল জানো?”
পাঁচু মাথা নেড়ে বলল, “রামদুলাল আর তার নাতির কী হয়েছিল তা আর জানি না। লোকটা বড় জেদি আর একগুঁয়ে। রাজবংশের ধাত যাবে কোথায়। কতামশাইয়ের কাছে এলে রাজার হালে থাকতে পারত। কিন্তু তা সে করেনি। রাজ্যোদ্ধারের চেষ্টাতেই নাকি জীবনটা দিয়েছে। আর কতামশাইয়ের কথা তো জানোই। সেই পেতলের বাক্সের ধনসম্পত্তি দিয়ে এখানে জোতজমা করেছেন। নানা কারবারেও তাঁর মেলা টাকা খাটছে। কিন্তু সর্বদাই তিনি জানেন যে, এসব কিছুই তাঁর নয়। সেইজন্যেই তোমাদের কখনও বাবুয়ানা করতে দেন না, সর্বদা স্বাবলম্বী হতে শেখান।”
হাবুল বলল, “শ্বেত আর লোহিতের কথা কিছু বললে না?”
পাঁচু মাথা নাড়ল, “বলে লাভ নেই। তারা ঠিকই আসবে। কতামশাইকে তারা কোনওদিনই পছন্দ করত না। তবে এটা ঠিক, তাদের মতো বিশ্বাসী লোক হয় না। রামদুলাল বা নাতির জন্য তারা জান দিতে পারে। বুড়ো হয়েছে বলে দুর্বল ভেবো না। বুড়ো হাড়েও অনেক ভেলকি দেখাতে পারে। আজকের রাতটা কেটে গেলে তাদের জারিজুরি শেষ, এটা তারাও জানে। কাজেই আজ রাতে তারা আসবেই। হয়তো সহজপথে না এসে বাঁধা পথ নেবে। দু’জনেই অতিশয় ধূর্ত। সুতরাং ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার আশা ছাড়ো। অত সহজ কাজ নয়।”