“গন্ধর্বদা খুব কষ্ট পেয়ে এতদূর এসেছে।”
বিরু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আর একটু কষ্ট করে যদি আজকের বৈশাখী অমাবস্যাটা পার করে আসত, তা হলে আর কোনও ঝামেলা থাকত না।”
“কেন, ঝামেলা থাকত না কেন?”
“বাবার সঙ্গে নাকি রামদুলালের শর্ত ছিল আজকের বৈশাখী অমাবস্যা পার হয়ে গেলে এবং তার নাতি না এলে বিষয়সম্পত্তি চিরকালের মতো বাবার হয়ে যাবে। আর কোনও দায় থাকবে না। শ্বেত আর লোহিতও আর আসবে না।”
“ইশ! সত্যি?”
“বাবা তো তাই বলল, সবই প্রিমিটিভ আমলের ব্যাপার-স্যাপার।” বলে বিরু খানিকটা আনমনা হয়ে রইল। তারপর বলল, “কিন্তু আংটিটাই ঝামেলা পাকিয়েছে। ওই পয়মন্ত আংটির দামটাও বিশ্রীরকম বেশি, তার ওপর ওটা নিয়ে নানা কিংবদন্তী আছে, মেটেরিয়াল ভ্যালুর চেয়েও কিংবদন্তীর ভ্যালু অনেক হাই।”
হাবুল দাদুর জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ল। বলল, “আংটিটা কীভাবে চুরি গেল তা তুমি ভেবে পাচ্ছ?”
বিরু মাথা নেড়ে বলল, “না। চোর কোনও প্রমাণ রেখে যায়নি। তবে বাবা বলল, দুতিন দিন আগে এক সকালে উঠে বাবা ঘরের দরজা খোলা দেখেছে। বাবার ঘরে পাঁচুদাও শোয়। দু’জনের কারওই ভাল ঘুম হয় না, বারবার ওঠে। ফলে দু’জনেরই কেউ হয়তো একবার দরজা ঠিকমতো লাগাতে ভুলে গেছে। এই ভেবে বাবা আর বেশি উচ্চবাচ্য করেনি।”
“তোমার কাউকে সন্দেহ হয় না ছোটকা?”
“না, সন্দেহের স্টেজ এখনও আসেনি। এখন বিস্ময়ের স্টেজ চলছে। বিস্ময় কাটলে সন্দেহ শুরু হবে।”
বিরু শুয়ে-শুয়ে ঠ্যাং নাচাতে লাগল।
“তা হলে কী হবে ছোটকা?”
বিরু খুব চিন্তিত মুখে বলল, “একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। তবে তাতে কতদূর কাজ হবে তা জানি না।”
“কী আইডিয়া?”
“শ্বেত আর লোহিতকে যদি আজ রাতের মতো এবাড়িতে ঢোকা থেকে ঠেকিয়ে রাখা যায়, তা হলে অনেক দিক সামাল দেওয়া বাবে।”
হাবুল উজ্জ্বল হয়ে বলল, “খুব ভাল আইডিয়া ছোটকা।”
বিরু আনমনে ভাবতে-ভাবতে বলল, “আইডিয়া তো ভাল, কিন্তু ঠেকানো যাবে কী ভাবে, সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না। কোন্ দিক দিয়ে তারা আসবে, তা জানা নেই, তাদের চেহারা জানি না, কেমন স্বভাবের লোক তাও জানি না, ঠেকাব বললেই কি ঠেকানো যায়?
হাবুল সোৎসাহে বলল, “আমি তাদের চিনি। চলো, ঠিক খুঁজে বের করে ফেলব।”
“তারপর কী করবি?”
“রাস্তায় ল্যাং মেরে ফেলে দেব।”
বিরু এই বিপদের মধ্যেও হোহোহা করে হেসে উঠল। তারপর বলল, “ল্যাং মেরে ফেলে দিলে কি তারা ছেড়ে দেবে?”
“না, ঝগড়া করবে। আমিও ঝগড়া করব। করতে করতে রাত কেটে যাবে।”
বিরু আবার হেসে উঠে বলল, “তুই চাইলেও তারা সারা রাত ঝগড়া করতে চাইবে কেন? কাজের লোকেরা ঝগড়া-টগড়া করতে ভালবাসে না।”
“ল্যাংটা একটু জোরে মারলে পা মচকে গিয়ে যদি…”
ঠিক এই সময়ে দরজায় পাঁচু এসে দাঁড়াল। চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলছে, মুখে ফেটে পড়ছে চাপা রাগ। গলায় একটা ব্যাঘ্রগর্জনের মৃদু নমুনা তুলে বলল, “কী শলাপরামর্শ হচ্ছে তোমাদের তখন থেকে? বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়ো না।”
পাঁচুর মুখে-চোখে রাগ থাকলেও ধমকের তেমন তেজ নেই। শুয়ে পড়তে বলছে বটে কিন্তু সেটা চাইছে না।
হাবুল গিয়ে পাঁচুর হাত ধরে ঘরে টেনে এনে বলল, “পাঁচুদা, তুমি শ্বেত আর লোহিতকে চেনো?”
পাঁচু মেঝের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে ক্লান্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “খুব চিনি। তাদের কাণ্ডকীর্তির কথাও মেলা জানি। রামদুলালের বাড়ির মাটির তলার চোর-কুঠুরিতে এখনও শয়ে শয়ে মানুষের কন্স পাওয়া যাবে।”
পাঁচু কাঁধের গামছায় ঘামে ভেজা মুখ মুছে একটু দম নিয়ে বলল, “বাইরে থেকে তোমাদের কথা সব শুনেছি। শ্বেত আর লোহিতকে ঠেকানোর বুদ্ধিটা ভাল। রাত কেটে গেলে তারা কাল সকালে আর আংটি দেখতে চাইবে না। কিন্তু তাদের ঠেকানো বড় সহজ কাজ নয়। আমার তো ইচ্ছে ছিল দুটোকেই বল্লমে গেঁথে নিকেশ করে দিই। ফাঁসি হলে আমার হবে। কিন্তু কতামশাই সেকথায় চটে যান।”
বিরু সোজা হয়ে বসে বলল, “ঘটনাটা কী, একটু বলবে পাঁচুদা?”
পাঁচু মাথা নেড়ে বলল, “সে সাতকাহন গল্প। কতামশাই যখন দেশ ছেড়ে পশ্চিমে রওনা হন, তখন দেশে ঘোর আকাল। ট্রেনে চেপে যেতে-যেতে ভোরবেলা একটা জায়গায় গাড়ি থামতেই কতামশাই লটবহর নিয়ে নেমে পড়লেন। মনে-মনে নাকি সংকল্পই ছিল যেখানে ভোর হবে সেখানেই নেমে পড়বেন। তা জায়গাটা খুব খারাপও ছিল না। দু’চারদিন ঘোরাঘুরি করে একদিন এক মুদির দোকানে খবর পেলেন, কয়েক মাইল দূরে পাহাড়ে ঘেরা একটা আজব জায়গা আছে, সেখানে কাজ মিলতে পারে।”
বিরু বলল, “এ গল্প তো আমরা জানি। জায়গাটার নাম লক্ষ্মণগড়।”
“জানো, কিন্তু সবটা জানো না। লক্ষ্মণগড়ে রামদুলাল রায় রাজত্ব করত বটে, কিন্তু নামে মাত্র। জমিদার ঘোট, প্রজা মাত্র কয়েক ঘর। তার ওপর সাত শরিকে ঝগড়া। বড় তরফ রামদুলাল কতামশাইকে কাজ দেন। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েকে পড়ানোর কাজ। সামান্য বেতন। কষ্টেসৃষ্টে কামশাইয়ের চলে যেত। তবে একথা সত্যি যে, কয়েক বছরের মধ্যেই কতামশাই রামদুলালের খুব বিশ্বাসী লোক হয়ে উঠেছিলেন। সবাই জানত কতামশাই এক কথার মানুষ। সত্যবাদী, চালচলনে সংযত। এই সময়ে রাজবাড়ির বুড়ো-পুরুত মারা যাওয়ায় কতামশাইকে রামদুলাল পুরোহিতের কাজটাও দেন। তা বিশালাক্ষীর মন্দিরটা ছিল বহু পুরনো, অনেকদিন কোনও সংস্কার হয়নি। রামদুলালের এমন টাকা নেই যে, মন্দির সারাই করে। কামশাই তাই একদিন নিজের হাতেই মন্দির সংস্কার করতে লেগে গেলেন। আর সেই ঘটনাতেই যত বিপত্তি। সে-গল্প জানো?”