গন্ধর্ব ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছু বলল না। একটু হাসল মাত্র।
পড়ায় একদম মন লাগছিল না হাবুলের। দাদুর ঘরে বন্ধ দরজার পিছনে কী নিয়ে কথা হচ্ছে তা বারবার আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল সে।
অবশেষে রাত দশটা নাগাদ দরজা খুলে সকলে বেরিয়ে এল। প্রত্যেকের মুখই গম্ভীর এবং থমথমে। চুপচাপ যে যার ঘরে চলে গেল।
রাতে সকলেই একসঙ্গে খেতে বসল বটে, কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে ভাল করে কথা বলছিল না। গন্ধর্বকে শুধু ভদ্রতাসূচক দু একটা কথা বলা হল।
খাওয়ার পর হাবুলের ছোটকাকা বিরু এসে হাবুলের ঘরে ঢুকল। বিছানায় শুয়ে পায়ের ওপর পা তুলে হাঁটু নাচাতে নাচাতে বলল, “সব শুনেছিস?”
ছোটকাকা যেমন সাহসী, তেমনি আমুদে। ছোটকাকাকে হাবুল খুব ভালবাসে। সে বলল, “কিছু শুনিনি তেমন, কী হয়েছে ছোটকা?”
“কেস খুব খারাপ। আমাদের যা কিছু সম্পত্তি-টম্পত্তি আছে, সব নাকি ওই ছোঁকরার। বাবাকে নাকি ওর দাদু মেলা বিষয়সম্পত্তি দিয়েছিলেন। কথা ছিল তার নাতি কোনওদিন ফিরে এলে সব ফিরিয়ে দিতে হবে। সেই নাতি হান্ড্রেড পারসেন্ট হাজির।”
হাবুল হঠাৎ একটু রেগে গিয়ে বলে, “এই লোকটাই যে রামদুলালের নাতি, তার কোনও প্রমাণ আছে!”
বিরু ঠ্যাং নাচাতে নাচাতেই বলল, “আছে, একটা আংটি আর একটা চিঠি।”
“আর দাদু যদি সম্পত্তি ফিরিয়ে না দেয়?”
বিরু একবার হাবুলের দিকে তাকিয়ে নিল। তারপর একটা হাই তুলে
বলল, “বাবা সেরকম লোক নয়। রামদুলালের নাতি না এলে.সম্পত্তি দিতে হত না, কিন্তু এসে যখন পড়েছে, তখন উপায় নেই। আজ বৈশাখী অমাবস্যা। আজ রাতেই শ্বেত আর লোহিত নামে দুটো লোক আসবে। তারা রামদুলালের বিশ্বস্ত দুই প্রজা। তারা নাকি প্রত্যেক বৈশাখী অমাবস্যায় এসে দেখে যায় রামদুলালের নাতি, এল কি না। আমি অবশ্য কোনওদিন শ্বেত আর লোহিতকে দেখিনি। তুই দেখেছিস?”
হাবুল ভ্রূ কুঁচকে একটু ভাবল। তারপর বলল, “দেখেছি দু’জন ঠিক একরকম দেখতে। খুব স্ট্রং চেহারা, তবে বুড়ো। একজন ফর্সা, একজন কালো।”
“তা হলে ঠিকই দেখেছিস। তারা যমজ ভাই। তাদের ওপর হুকুম আছে সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া না হলে তারা বাবাকে খুন করবে।”
“ইশ, খুন করা অত সোজা?” হাবুল ফোঁস করে উঠল।
বিরু ঠ্যাং নাচানো বন্ধ করে বলল, “খুন করা যে সোজা নয়, তা ওরাও জানে, আমরাও জানি, ওরা এও জানে যে, খুন করার দরকারও হবে না। বাবা সবই ফিরিয়ে দেবে। তবে শ্বেত আর লোহিতকে আণ্ডারএস্টিমেট করাও ঠিক নয়। তারা এক সময়ে রামদুলালের লেঠেল ছিল। বিস্তর খুনখারাপি করেছে।”
“আমি দুই ঘুষিতে দু’জনকে…।”
“থাক থাক, আর বীরত্বে কাজ নেই। সম্পত্তি যখন ফিরিয়েই দেওয়া হচ্ছে তখন আর চিন্তা কী?”
হাবুল হঠাৎ কাকার দিকে তাকিয়ে বলল, “তা হলে সবাই চিন্তা করছে কেন?”
বিরু ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে ছাদের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবছিল। একটা শ্বাস ফেলে বলল, “ভাববার কারণ আছে।”
“কী কারণ?”
“বাবার কাছে রামদুলালের একটা আংটি ছিল। দামি হিরের আংটি, দেড় দু’লাখ টাকা দাম। ঠিক আংটি বললেও ভুল হবে, ওটা একটা রাজকীয় অভিজ্ঞান। গন্ধর্বর আঙুলেও ঠিক ওরকম একটা আছে। প্রতিবার বাবাকে শ্বেত আর লোহিত এলে সেই আংটি দেখাতে হয়। গতবারও দেখিয়েছে। আজ বৈশাখী অমাবস্যা বলে দুপুরবেলা নাকি আংটিটা বের করতে গিয়েছিল বাবা। দেখে, আংটি চুরি গেছে।”
হাবুল চমকে উঠে বলল, “চুরি! এবাড়ি থেকে?”
“সেইটেই তো আশ্চর্যের বিষয়। বাবা নিজে দারুণ সাবধানী, তার ওপর এতগুলো লোক আমরা রয়েছি বাড়িতে, জিমি আছে, চুরি গেল কী করে সেটাই রহস্য।”
“দাদু কী বলল?”
“কী করে চুরি গেল তা বাবা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। আংটিটা ছিল লোহার আলমারির মধ্যে, চাবি বাবার কাছে থাকে। ত্রিবেলা বালিশের নীচে চাবির গোছা নিয়ে শুয়ে থাকে। তবু চুরি গেছে।”
“তোমরা পুলিশ ডাকবে না ছোটকা?”
“সে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু আজ রাতে শ্বেত আর লোহিত এলে তো সেই আংটি দেখানো যাবে না।”
“আজই দেখাতে হবে? দুদিন সময় নিলে হয় না?” বিরু মাথা নেড়ে বলল, “না, শ্বেত আর লোহিত প্রিমিটিভ ওয়ার্ল্ডের লোক। কতগুলো অন্ধ কুসংস্কার মেনে চলে। বৈশাখী অমাবস্যার রাত ছাড়া ওই আংটির দিকে যে তাকাবে, সে-ই নাকি অন্ধ হয়ে যাবে। অবশ্য রামদুলালের বংশধররা ছাড়া।”
“যাঃ, যত সব গুলগল্প।”
বিরু হাসছিল। ঠ্যাং নাচানো অব্যাহত রেখে বলল, “তা হবে, কিন্তু আমার বাবাও সেই গুলগল্প বিশ্বাস করে। বাবাও বৈশাখী অমাবস্যা ছাড়া ওই আংটির দিকে কখনও তাকায়নি। প্রবলেম হল, শ্বেত আর লোহিতকে যদি আংটি না দেখানো যায়, তবে তারা খুব ঠাণ্ডা মাথায় বাবাকে খুন করার প্ল্যান নেবে।”
“নিক না। আমরাও পুলিশে খবর দিচ্ছি।”
বিরু একটু ম্লান হেসে ধমক দিল, “দূর বোকা! খুনের ভয়টাই কি একমাত্র ভয়? আংটি চুরি যাওয়াটা লজ্জার ব্যাপার না? বিশেষ করে আজই যখন রামদুলালের নাতি তার বিষয়সম্পত্তি দাবি করতে এসেছে, ঠিক সেদিনই আংটিটা খুঁজে না-পাওয়া একটা বিশ্রী অস্বস্তির কারণ। বাবা ভীষণ ভেঙে পড়েছে।”
“গন্ধর্ব চুরির কথা জানে?”
বিরু মাথা নেড়ে বলল, “গন্ধর্ব কিছুই জানে না।”
হাবুল গম্ভীর হয়ে বলল, “গন্ধর্বদা খুব ভাল লোক।”
“হ্যাঁ, আমার সঙ্গেও আলাপ হয়েছে। বেশ ছেলে, চালাক চতুর। তোর মতো হাবা নয়।”