“আমাদের কাছে বলতে না চাইলেও পুলিশ কিন্তু তোমার কাছ থেকে কথা বের করবে।”
“আমি আপনার সঙ্গে একটু প্রাইভেটলি কথা বলতে চাই।”
বীরেনবাবু সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠে বললেন, “খবরদার না। ওসব প্রাইভেট কথা বলার নাম করে নির্জন, নিরিবিলিতে গিয়ে একটা হামলা করে পালানোর মতলব তো? সে হবে না।”
বিজয়বাবু শান্তভাবেই বললেন, “না রে, হামলা করার মতো অবস্থা এর এখনও নয়। তা ছাড়া আমার কাছে ওর পিস্তলটা তো আছেই। তোরা বরং আমার ঘরের বাইরে পাহারায় থাকিস। এসো হে, তোমার প্রাইভেট কথাই শোনা যাক।”
বিজয়বাবু লোকটাকে নিয়ে গিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বাড়ির লোকেরা বাইরে পাহারায় রইল।
দরজা বন্ধ করে লোকটাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে বিজয়বাবু মুখোমুখি বসে বললেন, “এবার বলো কী বলতে চাও?”
লোকটা বলল, “আমাকে দয়া করে পুলিশে দেবেন না। আমি তেমন কোনও অপরাধ করিনি।”
“ট্রেসপাসিং এবং ছদ্মবেশে ঘোরা কি অপরাধ নয়?”
“প্রথম কথা আমি ট্রেসপাস করিনি। বাড়ির কর্তা বীরেনবাবুই আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিয়েছেন। আর ছদ্মবেশ অপরাধ হলে বহুরূপীদের ধরে ধরে জেলে পোরা হত।”
“বুঝলাম। কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য কী? খুলে বলো!”
“সবটা বলার উপায় নেই। তবে আমার নাম অগ্নি। এই অঞ্চলে যে মাঝে মাঝে অদ্ভুত ধরনের সবুজ রঙের মানুষ দেখা যাচ্ছে, এই খবরটা পেয়েই আমার আসা। গত সাতদিন ধরে আমি এখানকার মাঠ, ঘাট, জঙ্গল চষে বেড়িয়েছি। কোনও সবুজ মানুষের দেখা পাইনি। বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলেও দেখেছি। কেউই সবুজ মানুষ দেখেছে বলে স্বীকার করেনি। আমার ক্রমে বিশ্বাস হচ্ছিল যে, এটা একটা গুজব ছাড়া কিছুই নয়। আমি ফিরে গিয়ে সেই কথাই কর্তৃপক্ষকে জানাব বলে ঠিক করেছিলাম। আর আজই আমার ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু আজকেই ভাগ্যক্রমে আমি এই বাড়িতে
একজন সবুজ মানুষের দেখা পেয়ে গিয়েছি।”
“তুমি ভুল দেখেছ।”
লোকটা মাথা নেড়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, “না মশাই, আমি একটুও ভুল দেখিনি। লোকটা বেজায় লম্বা, অন্তত সাড়ে সাত ফুট তো হবেই। রোগাটে কিন্তু জোরালো চেহারা, গায়ে আঁট করে পরা কালচে রঙের পোশাক। অনেকটা ডুবুরিদের পোশাকের মতো।”
“ডুবুরিদের সর্বাঙ্গ পোশাকে ঢাকা থাকে, গায়ের রং বোঝার উপায় নেই।”
“এ লোকটার মুখ, দুটো হাত আর হাঁটুর নীচের অংশ খোলা ছিল।”
বিজয়বাবু হাসলেন, বললেন, “তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সাড়ে সাত ফুট লম্বা সবুজ রঙের কোনও লোক যদি এখানে থাকত, তা হলে গ্রামদেশে একটা হইচই পড়ে যেত। এরকম অদ্ভুতদর্শন কোনও লোককে এখানে কারও কখনও চোখে পড়েনি। পড়লে অবশ্যই আমাদের কানে সে খবর আসত।”
“আপনার কি মনে হচ্ছে আমি মিথ্যে কথা বলছি?”
“না। তাও মনে হচ্ছে না। কারণ, মিথ্যে করে এ গল্প বলে তোমার কোনও লাভ নেই। কিন্তু আমি তোমাকে বলতে চাইছি যে, তুমি যা দেখেছ তা একটা ইলিউশন মাত্র। গাছের ছায়ায় কেউ হয়তো দাঁড়িয়ে থাকলেও থাকতে পারে। ওই ঝোঁপঝাড়ের অন্ধকারে কারও গায়ের রং বোঝা সম্ভব নয়। তা ছাড়া তুমি একজন সবুজ রঙের লোককে খুঁজছিলে বলে তোমার ভিতরে একটা অটো সাজেশন তৈরি হয়েছিল। তাই বলছি, ওটা চোখের বিভ্রম ছাড়া কিছু নয়।”
লোকটা যেন একটু ধন্দে পড়ে গেল। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে একটু ভেবে তারপর মুখ তুলে বলল, “আপনি বিচক্ষণ মানুষ, তাই আপনাকে একটা ঘটনার কথা বলতে চাই।”
“বলো।”
“দিনতিনেক আগে রাজবংশীদের পোডড়া বাড়ির মাঠে একজন দেহাতি বুড়ি খুঁটে দিচ্ছিল। অনেক খুঁটে।”
“হ্যাঁ জানি। ও হল দুধওলা রামভরোসার মা গিরিজাবুড়ি।”
“অত খুঁটে দেওয়া দেখে আমি একটু অবাক হয়েছিলুম। কারণ, আজকাল কয়লা বা গুলের উনুনে রান্না করা একরকম বন্ধই হয়ে গিয়েছে। গাঁয়ের লোকও এখন গ্যাস বা কেরোসিনে রান্না করে। আমি তাই সেই বুড়িকে গিয়ে বললাম, এত খুঁটে কার জন্য দিচ্ছ গো মাসি? কে নেবে? তখন বুড়িটা একটুফুঁসে উঠে বলল, তোরা লা লিবি তো লা লিবি। হমার ঘুটিয়া হারা আদমিরা লিবে।”
“তার মানে?”
“হারা আদমি মানে সবুজ মানুষ। তখন আমি বুড়িকে ধরে পড়লাম। কিন্তু আমার আর একটি কথারও জবাব দিল না। গম্ভীর মুখে ঘুঁটে দিয়ে যেতে লাগল। তার মানে কি এই নয় যে, ওই গিরিজাবুড়ির সঙ্গে সবুজ মানুষদের একটা যোগাযোগ আছে?”
বিজয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তুমি কি জানো যে, গিরিজাবুড়ি রোজ ভূত দেখতে পায়, রাজবংশীদের বাড়িতে পরিদের আনাগোনা টের পায় এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস যে, জলার ওধারকার জঙ্গলে একটা রাক্ষসও বসবাস করে?”
“বুড়োবুড়িদের কথায় নানা অসংগতি থাকে একথা ঠিক। কিন্তু সবুজ মানুষের কথা বলেছিল বলে আমার একটু বিশ্বাস হয়েছিল।”
“গিরিজাবুড়ি রোজ আমাদের বাড়িতে শাক তুলতে আসে। সারাক্ষণ বকবক করে যায়, যার কোনও মাথামুণ্ডু নেই।”
অগ্নি নামের লোকটা কিছুক্ষণ নিজের করতলের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “তা হলে আপনি বলছেন যে, এখানে সবুজ মানুষের অস্তিত্ব নেই?”
“না, নেই।”
“আপনি কি একজন বৈজ্ঞানিক?”
“দুর পাগল! বৈজ্ঞানিক বললে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তবে কলেজে বিজ্ঞান পড়াতাম। আমার গবেষণার খুব শখ ছিল বলে একটা ছোট ল্যাবরেটরি করেছি। সেটা আমার খেলাঘর বলতে পারো। কাজের কাজ কিছুই হয় না।”