লোকটা জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চেটে বলল, “একটু জল দেবেন? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।”
জল খেয়ে লোকটা যেন একটু ধাতস্থ হল। হাতে ভর দিয়ে উঠে বসবারও চেষ্টা করতে লাগল।
বীরেনবাবু বীরের গলাতেই বলে উঠলেন, “উঁহু, পালানোর চেষ্টাও কোরো না, পুলিশে খবর দিতে লোক গিয়েছে। এই এল বলে। পিস্তল নিয়ে দিনেদুপুরে লোকের বাড়িতে ডাকাতি করতে ঢোকা বের করছি তোমার।”
বটু আর হরেন গিয়ে ঘরে লোকটাকে বসানোর পর লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “ডাকাত নই মশাই!”
“তবে তুমি কে?”
“বলা বারণ আছে।”
“ওসব চালাকি করে পার পাবে না হে। শক্ত পাল্লায় পড়েছ।” লোকটা জবাব দিল না। মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর দুর্বল গলায় বলল, “আমার পিস্তলটা কি ফেরত দেবেন?”
বীরেনবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “পিস্তল! পিস্তল ফেরত চাও? তুমি তো বিপজ্জনক লোক হে! পিস্তল নিয়ে নিজের মূর্তি ধরবে বুঝি?”
লোকটা ক্লান্ত গলায় বলল, “আমি খুব ভাল লোক নই বটে। কিন্তু আপনাদের কোনও ক্ষতি করতে আসিনি।”
বিজয়বাবু ঠান্ডা মাথার মানুষ। নরম গলায় বললেন, “তুমি কে তা না হয় না বললে। কিন্তু ঘটনাটা কীভাবে ঘটল, কে তোমাকে মারধর করল, সেটা তো বলতে পারো?”
“একজন সবুজ মানুষ।” হরেন বলে উঠল, “ও তো…।”
কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারল না, বিজয়বাবু একটা ধমক দিয়ে বললেন, “বেশি কথা না বলে দৌড়ে গিয়ে এক কাপ গরম দুধ নিয়ে আয় তো৷”
হরেন মিইয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
বীরেনবাবু সখেদে বললেন, “চোর-ডাকাতকে গরম দুধ খাওয়ানোটা কি ঠিক হচ্ছে বিজয়দাদা? এরকম আপ্যায়ন হলে যে ঘনঘন তারা এসে এ বাড়িতে চড়াও হবে? ওদের সঙ্গে কুটুম্বিতা কি ভাল?”
বিজয়বাবু উত্তেজিত না হয়ে মৃদু হেসে বললেন, “দ্যাখো বীরেন, লোকটা চোর-জোচ্চোর কি না তা এখনও জানা যায়নি। লোকটা উন্ডেড, অসুস্থ। শুশ্রূষা দরকার। চোর-ডাকাত বলে মনে হচ্ছে না আমার।”
এ বাড়িতে বিজয়বাবুকে সবাই একটু খাতির করে। একসময় বড় কলেজে বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। বিয়েটিয়ে করেননি। এখন এই বাড়িতে নিজের মতো একটা ল্যাবরেটরি করে গবেষণা নিয়ে আছেন। কিন্তু তাঁর বুদ্ধি-বিবেচনা আর কাণ্ডজ্ঞান অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। ব্যক্তিত্বও সাংঘাতিক। চাপা স্বভাবের মানুষ বলে কেউ তাঁকে বড় একটা ঘটায় না।”
গরম দুধটুকু লোকটা এক চুমুকে শেষ করে বলল, “এবার আমাকে ছেড়ে দিন।”
বীরেনবাবু বললেন, “ছেড়ে দেব মানে? তুমি কে, কোন মতলবে এখানে উদয় হয়েছ, নামধাম, ইতিবৃত্তান্ত কী, এসব
জেনেই ছেড়ে দেব নাকি? পুলিশ আসুক, তারপর যা ব্যবস্থা হওয়ার হবে।”
বিজয়বাবু নরম গলাতেই বললেন, “উঠে দাঁড়াতে পারবে?”
“পারব।”
“তা হলে এই ভেজা মাটিতে বসে না থেকে ওই দাওয়ায় গিয়ে বসবে চলো।”
“আমি চোর-ডাকাত নই, আবার ভিখিরি-কাঙালও নই। এখানে একটা জরুরি কাজে এসেছিলাম।”
“কাজটা কী?”
“সবুজ মানুষ।”
“সবুজ মানুষ বলে কিছু নেই। ওটা আষাঢ়ে গল্প।”
“আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি ওই বারান্দাটায় বসে মুড়ি খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি, এই ঝোঁপঝাড়ের ভিতর অন্ধকার থেকে একটা লম্বা, ঘন সবুজ রঙের মানুষ উঁকি দিচ্ছে। যা শুনেছিলুম, হুবহু সেইরকম।”
হঠাৎ বিজয়বাবুর চোখ দুটো যেন ধক করে জ্বলে উঠল। চাপা হিংস্র গলায় বললেন, “কী শুনেছিলে?”
“এখানে সবুজ রঙের মানুষ আছে।”
“এরকম অবাস্তব গল্প কে তোমাকে বলেছে? সবুজ মানুষ থাকলে আমরা দেখতুম না? আর তুমি কোমরে পিস্তল নিয়ে সবুজ মানুষ খুঁজতে এসে ভয়ংকর অন্যায় করেছ। যদি ভুল দেখে গুলি চালিয়ে দিতে তবে একজন নিরীহ মানুষ মারা পড়তে পারত?”
“গুলি চালানোর হুকুম নেই। আমি চালাইওনি গুলি।”
“তবে পিস্তল নিয়ে এসেছিলে কেন?”
“আত্মরক্ষার জন্য।”
“আত্মরক্ষার নামে দুনিয়ায় অনেক খুনখারাপি হয়ে থাকে। ওই অজুহাতটা আমি বিশ্বাস করছি না। ঠিক আছে, তর্কের খাতিরে আমি মেনে নিচ্ছি যে, তুমি একটা সবুজ রঙের মানুষ দেখেছ। কিন্তু সে কি তোমার কোনও ক্ষতি করেছে?” ৪০
“ক্ষতি করেছে কি না সেটা তো নিজের চোখেই দেখছেন। আমার মৃত্যুও হতে পারত।”
“বিনা কারণেই কি লোকটা তোমাকে অ্যাটাক করেছিল?” লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি সবুজমানুষ দেখে মুড়ির বাটি ফেলে ছুটে আসছিলাম। লোকটার কাছে পৌঁছোনোর আগেই একটা লম্বা হাত এসে আমার মাথায় হাতুড়ির মতো একটা ঘুসি মারল। আমি অজ্ঞান হওয়ার আগে দেখতে পেলাম, সবুজ লোকটা দৌড়ে গিয়ে এক লাফে ওই প্রায় দশ ফুট উঁচু দেওয়ালটা পার হয়ে গেল।”
একচন্দ্র বলল, “ওরে, হাইজাম্পের বিশ্বরেকর্ড যেন কত ফুট, একটু খোঁজ নিয়ে দ্যাখ তো!”
বিজয়বাবু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, “তোমার মাথার ঠিক নেই। তুমি ভুল দেখেছ এবং ভুল খবর পেয়ে এসেছ। এখন যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব দাও।”
“বলুন?”
“এই পিস্তলের লাইসেন্স কি তোমার আছে?”
“আছে।”
“না থাকলে কিন্তু বিপদে পড়বে। দ্বিতীয় প্রশ্ন, তুমি কি ছদ্মবেশ পরে এসেছ? তোমার পোশাকের সঙ্গে কথাবার্তা মিলছে না।”
“হ্যাঁ, ছদ্মবেশ।”
“ছদ্মবেশ ধরার কারণ কী?”
“হুকুম হয়েছিল গাঁয়ের মানুষ সেজে আসতে।”
“কারা তোমাকে পাঠিয়েছে সেটা তুমি বলতে চাও না?”
“না।”