যারা রটিয়ে বেড়ায় যে, হরেন রোজ নারকোল গাছে উঠে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয়, তারা মোটেও সত্যি কথা বলে না। তবে হ্যাঁ, এ কথাও ঠিক যে, নারকোল গাছের মাথাটা ভারী ভাল জায়গা। সেখানে উঠলে গায়ে মিঠে মোলায়েম হাওয়া এসে লাগে! মিষ্টি রোদ আর নারকোল পাতার ঝিরিঝিরি ছায়া, আর সেইসঙ্গে গাছের মৃদুমন্দ দোলে যদি ঘুম এসেই যায়, তা হলে কাউকে দোষও দেওয়া যায় না। আর তাই হরেন গাছের সঙ্গে কোমরটা গামছা দিয়ে কষে বেঁধে নিয়ে খানিকটা ঘুমিয়ে নেয় বটে। তবে আসলে সে গাছের ডগায় বসে এই গঞ্জশহরের চারদিকটা নজরে রাখে বই তো নয়! নজরদারি করার মতো কিছু ঘটনাও আজকাল ঘটতে লেগেছে। আর সেইসব ঘটনা গাছের ডগা থেকে যতটা দেখা যায় মাটিতে দাঁড়িয়ে তার সিকিভাগও দেখার উপায় নেই।
আজও ঘুম ভাঙার পর গোটা কয়েক হাই তুলে আর আড়মোড়া ভেঙে চারদিকটা দেখছিল হরেন। ওই তো চিমসে চেহারার মিতব্যয়ী নিশাপতিবাবু দেড়শো গ্রাম চাল, দুটি আলু, একচিমটি ডাল আর দুটি পুঁটিমাছ কিনতে বাজারে চলেছেন। থানার হোঁতকা সেপাই লাটু হাজারি চৌপথির বটতলায় ইটের উপর বসে উপেন নাপিতের কাছে বিনা পয়সায় আরামসে খেউরি হচ্ছে। নধরকান্তি চিন্তামণি সমাদ্দারের মিষ্টি খাওয়া বারণ বলে, ওই যে বলরাম ঘোষের মিঠাইয়ের দোকানের পিছনে দাঁড়িয়ে শালপাতায় মুখ আড়াল করে টপাটপ জিলিপি খাচ্ছে। এসব রোজকার চেনা দৃশ্য। না, নতুন কিছু দেখা যাচ্ছে না।
কোমর থেকে গামছাটা খুলে মুখের ঘাম মুছে গাছ থেকে নামবার তোড়জোড় করছিল হরেন। এমন সময় তার নজর গিয়ে পড়ল দেওয়াল-ঘেঁষা জায়গাটায়। ওখানটায় মেলা গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গল। কামিনী ঝোঁপের লাগোয়া একখানা ফাঁদালো গন্ধরাজ লেবুর ছড়ানো গাছ। নীচেটায় ভারী অন্ধকার। সেইখানে ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে কার যেন দু’খানা ঠ্যাং একটুখানি বেরিয়ে আছে। পায়ের পাতা দুটো উপর দিকে ওলটানো, তার মানে লোকটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
দৃশ্যটা দেখে হাত-পা একটু ঝিমঝিম করে উঠল হরেনের, সর্বনাশ! কার আবার কী হল রে বাবা! তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে গাছের ঘষটানিতে বুকের নুনছাল উঠে গেল হরেনের। নেমেই হাঁফাতে হাঁফাতে সে লেবুতলায় হাজির হয়ে যাকে দেখতে পেল, সে মোটেও চেনা মানুষ নয়। মাথা ন্যাড়া, তাতে আবার টিকিও রয়েছে, পরনে হেঁটো ধুতি, গায়ে একটা জামা। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপারটা হল, জামাটা উলটে আছে বলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, লোকটার কোমরের কষিতে একটা ঝকঝকে পিস্তল।
হরেনের চেঁচামেচিতে লহমায় লোক জড়ো হয়ে গেল।
বীরেনবাবু কাহিল গলায় বললেন, “কী সব্বোনেশে লোক! পিস্তল নিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে! দেখে তো মনে হয়েছিল ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না!”
বটু গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি তখনই বলেছিলাম কিনা কর্তাবাবু, ভেচকুড়ি-কাটা লোককে মোটেও বিশ্বাস নেই।”
বীরেনবাবু আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, “কিন্তু কাজটা কি তুই ভাল করলি বটু?”
“কোন কাজটা?”
“এই যে লোকটাকে খুন করে ফেললি? খুনটুন নিজের হাতে করা কি ভাল রে? বরং পুলিশকে জানালেই তো হত!”
বটু আকাশ থেকে পড়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “কী বলছেন কর্তাবাবু? জীবনে মশা-মাছিটা অবধি মারিনি, আর আমি অমন দশাশই লোককে খুন করতে যাব? দক্ষিণের দাওয়ায় বসিয়ে শশা আর মুড়ি খেতে দিয়ে আমি তো ঘানি থেকে সরষের তেল আনতে গিয়েছিলুম। ফিরেই চেঁচামেচি শুনে এসে দেখি এই কাণ্ড!”
বীরেনবাবু চিন্তিত হয়ে বললেন, “তা হলে একে মারল কে?”
একচন্দ্র নিবিষ্ট মনে হাঁটু গেড়ে বসে লোকটার নাড়ি দেখছিল। মাথা নেড়ে বলল, “না হে, মরেনি। তবে মাথায় আর ঘাড়ে চোট হয়েছে দেখছি। চোখে-মুখে জলের ঝাঁপটা দিলে জ্ঞান ফিরতে পারে।”
বিজয়বাবু বললেন, “দাঁড়াও বাপু, জ্ঞান ফেরার আগেই ওর অস্ত্রটা সরিয়ে নেওয়া দরকার। জ্ঞান ফেরার পর কোন মূর্তি ধরে তার ঠিক কী?” এই বলে তিনি গিয়ে লোকটার কোমর থেকে সাবধানে পিস্তলটা খুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বললেন, “এ তো বেলজিয়ামে তৈরি অত্যাধুনিক জিনিস। এরকম একটা পেঁয়ো টিকিধারী লোক এটা পেল কোথায়?”
বীরেনবাবু বললেন, “হয়তো কুড়িয়ে টুড়িয়ে পেয়েছে।”
বিজয়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, “এ জিনিস রাস্তায়-ঘাটে কুড়িয়ে পাওয়া শক্ত। লোকটা হয় ডাকাত, না হয় ছদ্মবেশী পুলিশ।”
ব্রজবিহারী সভয়ে বললেন, “ও বাবা! তা হলে জ্ঞান ফেরার আগেই ওর হাত-পা বেঁধে ফেলা হোক। সাবধানের মার নেই!”
বিজয়বাবু মৃদু হেসে বললেন, “তার দরকার নেই। মূর্ছা ভাঙলেও লোক চট করে গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠার অবস্থায় থাকে না। তার উপর এর মাথায় আর ঘাড়ে চোট রয়েছে। বটু বরং গিয়ে বনবিহারী ডাক্তারকে ডেকে আনুক।”
চোখে-মুখে বেশ কিছুক্ষণ জলের ছিটে দেওয়ার পর লোকটা চোখ চাইল বটে। কিন্তু চোখের চাউনি ভ্যাবলা আর ফ্যালফ্যালে। যেন কিছুই বুঝতে বা চিনতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ টালুমালু করে চারদিকটা দেখার চেষ্টা করে হঠাৎ ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “লোকটা কোথায় গেল? অ্যাঁ! লোকটা?”
সবাই মুখ তাকালাকি করে অবশেষে বিজয়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কে হে, কার কথা জিজ্ঞেস করছ?”
“ওই যে সবুজ রঙের লোকটা!” সবুজ রঙের লোক শুনে একচন্দ্র মাথা নেড়ে বলল, “মাথায় চোট হলে অনেক সময় লোকে ভুলভাল বলে। সবুজ লোক কোথা থেকে আসবে? ওহে বাবু, সবুজ পোশাক পরা কাউকে দেখেছ নাকি?”