“তাই তো রে! তুই যে ভাবিয়ে তুললি! আমার চশমার যে এত গুণ তা তো আমিই এতকাল টের পাইনি!”
“আজ্ঞে, স্বাতী নক্ষত্রের জল, পাত্রবিশেষে ফল। সকলের কি সব কিছু সয় খুড়ো? নীলার আংটি যেমন, কারও হাতে গেলে পৌষমাস, কারও হাতে সর্বনাশ।”
অঘোরখুড়ো খুব চিন্তিত গলায় বললেন, “কথাটা বোধহয় খুব একটা মন্দ বলিসনি। চশমাটার মধ্যে কিছু অশৈলী ব্যাপার থাকলেও থাকতে পারে। ওটা চোখে দিলে মাঝে মাঝে কিম্ভুত সব জিনিস দেখা যায় বটে।”
“কীরকম খুড়ো?”
“আগে ভাবতুম বয়সের দোষে ভুলভাল দেখছি। কিন্তু এখন তলিয়ে ভেবে দেখলুম, সেটা চশমার গুণেও হতে পারে।”
“তা কী দেখতে পান খুড়ো? ভূতটুত নাকি?”
“ভূতও হতে পারে। তবে মাঝে মাঝে চশমাটা খুব আবছা হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ আবছায়া কেটে গিয়ে হয়তো দেখলুম, ঘরের মধ্যে একটা খুব ঢ্যাঙা লোক উবু হয়ে কী যেন খুঁজছে। সাড়া দিতেই ফুস করে কোথায় যেন সটকে পড়ল। তারপর ধর, আমার জানলার ওধারে কদমতলার মাঠ। জ্যোৎস্না রাতে মাঝে মাঝে দেখতে পাই কয়েকটা খুব ঢ্যাঙা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের গায়ের রং যেন কেমন সবজে সবজে।”
“তা হলে ও চশমা আপনি কানুকেই দান করে দিন খুড়ো। ও আপনার সইবে না।”
“দান করে দেব কী রে? ও যে খাঁটি সোনার চশমা! বটুকবুডোর বাতব্যাধির চিকিৎসা করেছিলুম। বটুক খুশি হয়ে মরার আগে চশমাজোড়া আমাকে দিয়ে যায়। আমার চোখেও দিব্যি ফিট হয়ে গেল। দিনের বেলা দিব্যি সব স্পষ্ট দেখা যায়। রাতের দিকেই যা একটু গন্ডগোল হয়।”
“চশমা ছাড়াই যখন আপনি সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, তখন ওই অলক্ষুনে চশমা চোখে দেওয়ার দরকার কী আপনার?”
“তা বটে, তবে কী জানিস, চশমা পরলে একটা ভারিক্কি ভাব আসে। লোকে একটু মান্যিগন্যি করে। চশমা একটা কেতার জিনিস তো! চোখে দিলে বাহারও হয় খুব!”
“যদি অভয় দেন তো একটা কথা কব?”
“কী কথা?”
“বলছিলুম কী, এখন কি আর আমাদের সেই বয়স আছে? এই জাগতিক তুচ্ছ জিনিসপত্রের উপর লোভ করা কি আমাদের শোভা পায়? আমাদের এই বুড়ো বয়সে তো জাগতিক বস্তু ছেড়ে পরমার্থেরই খোঁজ করা উচিত? কী বলেন?”
অঘোরখুড়ো খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “তুই বুড়ো হচ্ছিস তো যত খুশি হ। কিন্তু তোর দলে আমাকে ভেড়াচ্ছিস কেন? আমি মোটেও বুড়ো হইনি।”
নিমচাঁদ ভারী অবাক হয়ে বলল, “হননি? কিন্তু বয়সকালে বুড়ো হলে যে বড় সমস্যা হবে খুড়োমশাই!”
কথায় কথায় বাজারের কাছেপিঠে এসে পড়ায় লোকজন হাঁ করে দেখছিল তাঁদের। খগেন তপাদার বাজার সেরে ফিরছিল, দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, “বলি ও অঘোরখুড়ো, ভোটে জিতলেন, না ডবল সেঞ্চুরি করলেন?”
অঘোরখুড়ো খ্যাক করে উঠে বললেন, “তার মানে?”
“আজকাল তো দেখি ভোটে জিতলে, আর ডবল সেঞ্চুরি করলেই লোকে কাঁধে নিয়ে নাচানাচি করে। তা আপনার কোনটা?”
অঘোরখুড়ো ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “দ্যাখ খগেন, সব সময় রঙ্গ-রসিকতা ভাল নয়। কত বড় ভূমিকম্পটা হয়ে গেল দেখলি না? তার ধাক্কায় গাছ থেকে পড়ে মাজাটা ভেঙে দ’ হয়ে গেলুম, আর তুই রসিকতা করছিস?”
“তা ভূমিকম্প তো হয়েছিল এক বছর আগে, আপনার পড়তে এত সময় লাগল কেন বলুন তো? কত উঁচু গাছ যে, পড়তে এক বছর সময় লাগে?”
অঘোরখুড়ো খেপে গিয়ে বললেন, “তোরা কি নেশা করেছিস নাকি যে, এত বড় ভূমিকম্পটা টের পেলি না! মাত্র দশ মিনিট আগেই তো উপর্যুপরি ঝাঁকুনির চোটে আমি গাছ থেকে পড়লুম।”
বাজারের লোকজন মুখ তাকাতাকি করে বলতে লাগল, “না মশাই, ভূমিকম্প তো মোটেও হয়নি!”
খগেন তপাদার বলল, “ও ভূমিকম্প নয় খুড়ো, ও হল আপনার হৃৎকম্প।”
বিপদ বুঝে নিমচাঁদ ডবল গতিতে হাঁটা দিয়ে বলল, “সবার কথায় কান দেওয়ার দরকার কী আপনার বলুন তো খুড়োমশাই?”
অঘোরখুড়ো কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, “হারে, তুই না বুড়ো হয়েছিস? তোর নাকি হাতে-পায়ে আর আগের মতো জোর নেই! তা হলে এখন এই টাটুঘোড়ার মতো ছুটছিস কী করে?”
“ছুটছি নাকি?”
“আলবাত ছুটছিস!”
“ওইটেই বুড়ো বয়সের দোষ খুড়োমশাই, বয়সটা সব সময় খেয়াল থাকে না কিনা! ভীমরতিই হচ্ছে বোধহয়।”
“তোকে যে ভীমরতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে তা এখন আমি দিব্যি বুঝতে পারছি। ভেবে দেখলুম, যখন সবাই একই কথা বলছে, তখন একটু আগে যেটা হয়ে গেল সেটা মোটেও ভূমিকম্প নয়।”
নিমচাঁদ ভারী অবাক হয়ে বলল, “নয়! তা হলে কী হল বলুন তো?”
“কেউ গাছটা ঝাঁকিয়ে আমাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল।”
“এ তো ভারী অন্যায়।”
“তা তো বটেই। তা ভাবছি, অত বড় মজবুত একটা গাছকে ঝাঁকুনি দিয়ে নড়ানো তো যার-তার কম্মো নয়। মস্ত পালোয়ানের পক্ষেই সম্ভব। কী বলিস?”
কাঁচুমাচু হয়ে নিমচাঁদ বলল, “আজ্ঞে, ঠিক ইচ্ছে ছিল না খুড়োমশাই। কী করে যেন হয়ে গেল! বুড়ো বয়সের দোষ বলেই ধরে নিন।”
“বুড়ো বয়সের দোষ হবে কেন রে? এ সব নষ্টামি-দুষ্টামি কি বুড়ো মানুষের কাজ? এ তো করে বাচ্চা বখাটে ছেলেরা! তোর বয়স মোটেও বাড়ছে না, বরং কমছে। তুই আসলে ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছিস।”
চিন্তিত হয়ে নিমচাঁদ বলল, “এ তো বড় ধন্দে ফেলে দিলেন খুড়ো! বয়স বাড়ছে না কমছে, সেটাই যে এখন ঠিক ঠাহর পাচ্ছি না।