তবু নিমাদের ক’দিন হল মনে হচ্ছে, বুড়ো হতে আর বিশেষ বাকি নেই। তার বুড়ো বয়স এসে দরজায় কড়া নাড়ল বলে!
সকালে কথাটা তার ছেলে ভীমচাঁদকেও বলল। ভীমচাঁদের বয়স মোটে বারো।
“বুঝলি রে ভেমো, আমি বোধহয় শেষ অবধি বুড়োই হয়ে গেলুম।”
ভীমচাঁদ জানলার কাছে বসেইসকুলের পড়া করছিল। ভারী অবাক হয়ে বলল, “তাই নাকি বাবা? তা হলে তো বড় মুশকিল হল?”
“কেন রে? মুশকিলটা কীসের? বয়স হলে মানুষ তো বুড়োই হয়।”
“কিন্তু নোয়াপাড়ার ছেলেরা যে তা হলে দলবেঁধে আমাকে পেটাবে?”
“তোকে পেটাবে! কেন, তুই কী করেছিস?”
“ওদের ক্লাবের সেক্রেটারি গোবিন্দ নতুন সাইকেল কিনে খুব কায়দা করে চালাচ্ছিল দেখে আমি হিংসের চোটে ঢিল মেরে গোবিন্দর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলুম যে! তখনই ওরা শাসিয়ে রেখেছে, তোর বাবার গায়ে তো আর চিরকাল জোর থাকবে না। যখন বুড়ো হবে, তখন দলবেঁধে তোকে পেটাব। দেখব, তোর বাবা কী করতে পারে?”
নিমচাঁদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তাহলে হাটুরে মার খাওয়ার জন্য তৈরি হ’ রে ভেমো। আমি সত্যিই বুড়ো হতে চললুম।”
“তোমার গায়ে কি আর একটুও জোর নেই বাবা?”
দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে নিমচাঁদ বলল, “না রে বাবা, জোর বল খুবই কমে যাচ্ছে। পরশু দিন শিবাইচণ্ডীতলা দিয়ে আসছিলুম, দেখলুম, আমাদের দাগি ষাঁড় ভোলা বটতলায় শুয়ে আছে। শিং ধরে কতবার ভোলার ঘাড় মুচড়ে দিয়েছি। তা ভাবলুম, আজও একটু মুচড়ে দিই। ঠেলাঠেলি করে তাকে তোলার পর ভোলা রেগেমেগে তেড়ে এল বটে, আর আমিও তার ঘাড় মুচড়ে দিলুম ঠিকই। কিন্তু নাঃ, ঠিক আগের মতো হল না। ভোলাও যেন সেটা টের পেয়ে মিচিক মিচিক হাসছিল।”
ভীমচঁদ খুব চিন্তিতভাবে বলল, “তা হলে তো বড় মুশকিল হল বাবা। ইসকুলের নগেনমাস্টারমশাই পড়া না করলে সবাইকেই খুব বেত মারেন, শুধু আমাকে ছাড়া। তুমি বুড়ো হয়েছ জানলে যে নগেনস্যার আমাকে মেরে পাট পাট করবেন।”
“তা হলে বরং লেখাপড়াতেই মন দে রে ভেমো। আর আমার ভরসায় বসে থাকিস না।”
ভীমচাঁদ কাদো কাঁদো হয়ে বলল, “কিন্তু বাবা, তা হলে যে এখন থেকে লবঙ্গলতা স্টোর্সের বিশে আর বিনা পয়সায় লজেন্স বা চকোলেট দেবে না! গদাইয়ের দোকান থেকে খাতা-পেনসিল বিনা পয়সায় তুলে আনাও চলবে না। ইসকুলে বন্ধুরা পালা করে টিফিনের ভাগ দেবে না।”
নিমাদ দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হাতি কাদায় পড়লে কী হয় জানিস তো? না না, এখন থেকে তোরা সব ন্যায্য পয়সা দিয়েই জিনিসপত্তর কিনিস বাপ! আর গাজোয়ারি করে তুলে আনিস না।”
“ইস, তুমি আর কটা দিন পরে বুড়ো হলে আমি ততদিনে ক্লাস পরীক্ষাটাও পাশ করে যেতাম!”
“উঁহু, আর ওসব নয়। তিন-চার বিষয়ে ফেল মেরেও নতুন ক্লাসে ওঠা আর চলবে না। এখন থেকে সব বিষয়ে পাশ নম্বর পেতে হবে।”
নিমাদের বউ খবর পেয়ে হুলস্থূল হয়ে এসে ঘরের মধ্যে আছড়ে পড়ল, “ওগো, এ কী সব্বোনেশে কথা শুনছি! তুমি নাকি বুড়ো হয়েছ?”
“আহা, তাতে চেঁচামেচির কী আছে? বয়স হলে বয়সের নিয়মেই বার্ধক্য আসে। হুঁ হুঁ বাবা, এ হল অঙ্কের হিসেব।”
“কিন্তু আমার কী দুর্দশা হবে ভেবে দেখেছ? পাশের হাজরাবাড়ির কুঁদুলি বউটা পাড়ার সকলের সঙ্গে নেচে নেচে ঝগড়া করে বটে, কিন্তু আমি কিছু বললে বা দু’কথা শোনালে চুপ করে থাকে, রা-টি কাড়ে না। এখন তো সে আমারও বিষ ঝেড়ে দেবে রোজ। গলার হার ভেঙে এই যে বালা গড়িয়েছি, স্যাকরা কথাটি কয়নি। কিন্তু এখন সে কি মজুরি আদায় না করে ছাড়বে? আমি পাড়ায় বেরোলে লোকে কত খাতির করে রাস্তা ছেড়ে দেয়, রিকশাওয়ালা বিনা ভাড়ায় খেপ দিয়ে দেয়। আর কি ওসব হবে? এখন যে দুধওয়ালাও দুধের দাম চাইবে গো।”
নিমাদ গম্ভীর হয়ে বলল, “ওসব ভুলে যাও গিন্নি। এখন থেকে লোকের সঙ্গে ভাবসাব রেখে চলো। মনে রেখো, গয়না গড়ালে মজুরি দিতে হবে, রিকশায় উঠলে ভাড়া মেটাতে হবে, দুধ খেলে দাম দিতে হবে। আর এটাও যেন খেয়াল থাকে, সেইদিন আর নাই রে নাতি, থাবা থাবা চিনি খাতি।”
না, সেই দিন আর নেই-ই বটে। নিমচাঁদ যে বুড়ো হল! খুব চিন্তিত মুখে পাড়ায় বেরিয়ে খুব ধীরে ধীরে টুকটুক করে হাঁটছিল নিমচাঁদ। বয়স হয়েছে, এখন হুড়দৌড় করে হাঁটাচলা ঠিক হবে না। বুড়ো বয়সের নিয়মকানুন সব মেনে চলতে হবে। অধিক উত্তেজনা বারণ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধ, হাঁকডাক করা নিষেধ।
সে রাস্তায় বেরোলে চারদিকটা ভারী শুনশান হয়ে যায়, লোকজন সিঁটিয়ে থাকে, বাচ্চারাও কাঁদে না, লোকের কথাবার্তা, চায়ের দোকানে আড্ডা সবই যেন থেমে থাকে। আজও সেরকম হচ্ছে।
তবে এ আর ক’দিন? এরপর একদিন রাস্তায় বেরোলে তাকে দেখে আশপাশের লোকেরা টিটকিরি দেবে, বক দেখাবে, ছেলেপুলেরা পিছনে লাগবে, কেউ আর ফিসফিস করে একে অন্যকে বলবে না, “ওই দ্যাখ, নিমেপালোয়ান যাচ্ছে।’
রাস্তার ধারে একটা নধর ঝুপসি সজনেগাছ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল নিমচাঁদ। নিজের গায়ের জোর-বল নিয়ে আজকাল প্রায়ই তার খুব সংশয় হচ্ছে। তার ঘোর সন্দেহ, আগের মতো ক্ষমতা তার আর নেই। দোনোমনো করে সে গুটি গুটি সজনেগাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে তার দু’খানা মজবুত হাতে গাছটাকে সাপটে ধরে ‘হেঁইও’ বলে একটা হ্যাঁচকা চাড় দিতেই গাছটা কেঁপে উঠে যেন মানুষের গলাতেই চাপা স্বরে বলে উঠল, “বাপ রে! তবে গাছটা ওপড়াল না। নিমাদ আর-একবার দম নিয়ে ফের গাছটাকে সাপটে ধরে চাড় দিতেই গাছটা যেন একটা মর্মর ধ্বনি তুলে বলে উঠল, “হচ্ছেটা কী?’ নিমাদ আর-একবার গভীরভাবে শ্বাস টেনে গাছটাকে শক্ত করে ধরে চাড় মারতেই ঝুম্বুস করে শেকড়বাকড় আর মাটির চাঙড় সমেত গাছটা বিঘতখানেক উপরে উঠে পড়ল। নিমচাঁদ একটা স্বস্তির খাস ছেড়ে গাছটাকে আবার জায়গামতো বসাতেই উপর থেকে হুড়মুড় করে ডালপালা সমেত একটা লোক, “ভূমিকম্প হচ্ছে! ভূমিকম্প হচ্ছে।” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে মাটিতে চিতপাত হয়ে পড়ে গেল।