একটু উপর থেকে দেখা যাচ্ছিল, দশ-বারোজন সবুজ মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে খুব মন দিয়ে কিছু একটা দেখছে, তাদের প্রায় বাহ্যচৈতন্য নেই।
দু’দিকে বঙ্কা আর নিমচাঁদ, মাঝখানে বিজয়বাবু ঘরের ভিতরে নেমে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তীব্র ঝিঝির আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু এবার ঝিঝির আওয়াজে কোনও কথা
বুঝতে পারছেন না বিজয়বাবু। চুপচাপ লোকগুলোর দিকে চেয়ে বিজয়বাবু মনে মনে শুধু বললেন, “আমাকে ক্ষমা করুন। আপনাদের ক্ষতি করার ইচ্ছে ছিল না আমার। কিন্তু আমরা আমাদের মতো বেঁচে থাকতে চাই, যতদিন পারি।
হঠাৎ যেন তাঁদের উপস্থিতি এতক্ষণে টের পেয়ে সবুজ মানুষরা ফিরে তাকাল তাঁদের দিকে। তারপরই যেন স্তম্ভিত হয়ে কুঁকড়ে গেল। আর একের পর-এক ঢলে পড়ে গেল মাটির উপর।
বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে বিজয়বাবু মাটিতে পড়ে থাকা লম্বা আর সবুজ মানুষগুলোকে অপলক চোখে দেখছিলেন। শরীরে কোনও স্পন্দন নেই, ছটফটানি নেই। কেমন যেন কুঁকড়ে দলা পাকিয়ে শুয়ে আছে।
চশমাটা খুলে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসলেন তিনি। সামনে পড়ে থাকা লোকটার কবজি ধরে নাড়ি দেখার চেষ্টা করলেন। নাড়ির স্পন্দনের মতো নয়, কিন্তু সেতারের মতো দ্রুত একটা ঝিনঝিন শব্দ হচ্ছে যেন।
একটু সময় লাগল। তারপর দেখতে পেলেন কুঁকড়ে-যাওয়া শরীর যেন আরও কুঁকড়ে ভিতরকার কোনও কেন্দ্রাভিগ টানে দলা পাকিয়ে আস্তে আস্তে গোল গোল হয়ে আসছে, অনেকটা বলের মতো।
বিজয়বাবুর কবজির ঘড়িতে যখন সকাল ছ’টা বাজে তখন দেখতে পেলেন, মেঝের উপর মানুষগুলোর আকার আস্তে আস্তে ছোট্ট পোকার মতো হয়ে যাচ্ছে। মানুষের পোকা হয়ে যাওয়ার একটা কাল্পনিক গল্প ফ্রাঞ্জ কাকা লিখেছিলেন বটে, কিন্তু এটা তো গল্প নয়। কী করে এই রূপান্তর ঘটল, কোন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়, কিছুই বুঝতে পারলেন না বিজয়বাবু।
তবে একটা জিনিস দেখে এই দুঃখের ঘটনাতেও তিনি একটু খুশি হলেন। পোকাগুলো মৃত নয়। ছোট ছোট সবুজ গুবরেপোকার মতো আকারের সবুজ পোকারা একটু-আধটু নড়াচড়া করছে।
তিনি উঠে গুহাটা দেখলেন ভাল করে। এরা কি আসলে কোনওকালে পোকাই ছিল?মাটির নীচে থাকত? তারপর বিবর্তনের কোনও এক ধাক্কায় হয়ে গিয়েছিল লম্বা লম্বা মানুষ? এই চশমার কোনও রহস্যময় বিচ্ছুরণ কি আবার ওই বিবর্তনকে উলটো পথে চালিত করেছে? প্রশ্নগুলো জরুরি। কিন্তু জবাব কে দেবে?
নিমচাঁদ একটা থাবড়া তুলেছিল, “দেব নাকি নিকেশ করে?”
“না নিমচাঁদ। পৃথিবীতে নতুন প্রজাতির একটা পতঙ্গ হল। বেঁচে থাকতে দাও। পোকামাকড়কে যত বাঁচিয়ে রাখবে তো নিজেদের বাঁচার পথ প্রশস্ত হবে।”
বঙ্কা কাজের লোক, পোকামাকড় নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয়। ভিতরের কোনও উপগুহা থেকে দু’বস্তা সোনার চাকতি এনে বলল, “এই যে, দু’বস্তা। মেলা মোহর। কী করা যায় বলুন তো?”
“কিছু তুমি নাও, কিছু গাঁয়ের গরিব-দুঃখীকে দিয়ে। আর কিছু গাঁয়ের সংস্কারে কাজে লাগিয়ো৷”
ভিতরে আর-একটি প্রকোষ্ঠ থেকে পাঁচজন সংজ্ঞাহীন লোককে উদ্ধার করা হল, তাদের মধ্যে অগ্নিও। চোখে-মুখে জলের ঝাঁপটা দেওয়ার পর জ্ঞান ফিরতেই তাদের প্রশ্ন, “ওরা কোথায়?”
বিজয়বাবু শুধু বললেন, “চলে গিয়েছে।”
“আমাদের সমুদ্র?”
“আছে। চিন্তা নেই। ওরা আর আসবে না।”
বিজয়বাবু দেখতে পাচ্ছিলেন, পোকাগুলো মহানন্দে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেড়াক, ওরা এই নতুন জীবনও উপভোগ করুক।