অঘোরখুড়ো হুংকার দিয়ে বললেন, “তাই চশমাজোড়া পাচ্ছি না বটে! এ তা হলে তোমার কাজ?”
বিজয়বাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “আস্তে খুড়ো, আস্তে।”
বঙ্কা বিগলিত মুখে হাত কচলে বলল, “যে আজ্ঞে, আপনার চশমার গুণ আছে বটে খুড়ো। অন্ধকারেও সব দিব্যি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। কী বলব মশাই, মোট বারোখানা মোহর সরিয়েছি, দিব্যি গটগট করে বেরিয়েও এসেছি। তাই বলছিলাম, ওই বিটকেল লোকগুলোর সঙ্গে এমনিতে পেরে ওঠার জো নেই বটে, তবে…!”
বিজয়বাবু হাত বাড়িয়ে বললেন, “চশমাজোড়া কোথায়?”
বঙ্কা চশমাজোড়া খাপসুদ্ধ বের করে বিজয়বাবুর হাতে দিয়ে বলল, “আজ্ঞে, কাজ হয়ে গেলে যদি চশমাজোড়া বখশিশ দেন তবে কাজকর্মের বড় সুবিধে হয়। বড় অনটন চলছে।”
“ওই লোক দুটোর কী হল দেখলে?”
“আজ্ঞে, দেখেছি। ফেরার সময় দেখলাম তখনও লটকে পড়ে আছে। তবে সাইজে যেন একটু ছোট লাগল।”
“ছোট! কিন্তু এসব হয় কী করে? তারা সাপের কামড়ে মরে না, দুনিয়ার কোনও কিছুকে ভয় পায় না!”
অঘোরখুড়ো বললেন, “ও একটা ব্যাপার আছে।”
“কী ব্যাপার খুড়ো?”
“বটুকবুড়ো আমাকে বলেছিল, চশমার অনেক রকম গুণ আছে।
সব গুণের কথা বটুকবুড়োর জানা ছিল না। মন্ত্রটন্ত্রের ব্যাপার আর কী।”
বিজয়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, “তা হতে পারে না। একটা কোনও বিজ্ঞানসম্মত কারণ থাকতেই হবে। ঘরের বাতিটা নিভিয়ে দে তো নব। দেখি, সত্যিই অন্ধকারে দেখা যায় কিনা!”
নব বাতিটা নিভিয়ে দেওয়ার পর চশমার ভিতর দিয়ে বিজয়বাবু দেখলেন, তিনি ঘরের সবকিছুই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। এমনকী, আলোর চেয়েও অনেক স্পষ্ট।”
বিজয়বাবু চিন্তিতভাবে বললেন, “বঙ্কা যা বলছে তা যদি সত্যি হয়, তা হলে হয়তো একটা উপায় আছে। আমি আজই ওই গুহায় আবার যেতে চাই।”
সবাই ‘না না করে আপত্তি জানাতে লাগলেন। বিজয়বাবু বললেন, “আমাদের ঘোর বিপদ, ওই গুহায় ওদের বারোজন আছে। আরও হয়তো আছে, আমরা জানি না। কিন্তু বারোজনের একজন হচ্ছে ওদের লিডার। নাঃ, আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। বঙ্কা, তুমি চলো আমার সঙ্গে। একটু লুকিয়ে-চুরিয়ে ঢুকতে হবে বাপু। তুমি পথ দেখাবে।”
“যে আজ্ঞে। অন্ধিসন্ধি সব আমার জানা।”
নিশুত রাতে জঙ্গলে ঢোকার মুখেই একটা বাধা পড়ল। বিভীষণ চেহারার একটা লোক লাঠি হাতে পথ আগলে দাঁড়িয়ে। একটা হাঁক দিল, “কে রে?”
বিজয়বাবু বললেন, “নিমচাঁদ, আমি হে, বিজয়বাবু।”
নিমচাঁদ হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “বিজয়কর্তা, এই নিশুত রাতে এই জঙ্গলে কী মনে করে? এখানে যে সব বিটকেল কিম্ভুত জীবের আস্তানা। তারা যে সব কাঁচাখেগো দেবতা। এইবেলা পালিয়ে যান কর্তা।”
“সেই উপায় নেই নিমচাঁদ। পালিয়ে গেলে দুনিয়া ছারখার হয়ে যাবে।”
“কিন্তু কী করতে চান আপনি? হাতে বন্দুক-পিস্তল নেই। লাঠিসোঁটা নেই। তারা যে অসুরের চেয়েও বড় পালোয়ান! আমাকে এক ঝটকায় সাত হাত দূরে ছিটকে ফেলেছিল।”
“সেসব জানি। কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো হবে না। একটা চেষ্টা তো করতেই হবে।”
“তবে চলুন আমিও সঙ্গে যাই, আপনার সঙ্গে উটি কে?”
“এ হল বঙ্কা। পথ চেনাতে এসেছে।”
“খুব চিনি। পাকা চোর।”
বঙ্কা ভারী খুশি হয়ে বলল, “যে আজ্ঞে। বঙ্কার নাম পাঁচ গাঁয়ের লোক জানে।”
বঙ্কা জঙ্গলে ঢুকে আগে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “গুহার অনেক মুখ। সব মুখ দিয়েই ঢোকা যায় বটে, তবে বিপদও আছে। ওই খালধারের মুখটাই ভাল।”
অন্ধকারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে চশমা-পরা বিজয়বাবু সবকিছু স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল, চশমা থেকে কোনও একটা বিচ্ছুরণ হয়। নইলে এমনটা সম্ভব ছিল না।
বিজয়বাবু ভারী অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন ভাবতে ভাবতে। এই চশমা কোথা থেকে পেয়েছিলেন বটুকবুড়ো? কোন প্রযুক্তি বা অভিনব বস্তু দিয়ে এটা তৈরি তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। তবে চশমাটি অভিনব তাতে সন্দেহ নেই। দুনিয়াতে কত বিস্ময়ই যে এখনও আছে।
অন্যমনস্কতার দরুন বার দুই হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলেন। নিমচাঁদ ধরে ফেলল। নিচু স্বরে বলল, “এঁরা মানুষ তেমন খারাপ নয় বিজয়কর্তা। একটু কেমনধারা এই যা।”
“সেটা আমিও জানি। তবু পৃথিবীর পক্ষে এঁরা বিপজ্জনক। যদি এঁরা কোনও কারণে বিগড়ে যান তা হলে এক লহমায় বোধহয় দুনিয়া লয় করে দিতে পারেন।”
নিমচাঁদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তা পারেন কর্তা। এঁদের অসাধ্য কিছু নেই।”
খালধারের একটা ঢিবির সামনে এসে দাঁড়াল বঙ্কা। একটা শেয়ালের গর্তের মতো গর্ত দেখিয়ে বলল, “এইটে।”
বিজয়বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “এটা দিয়ে ঢুকব কী করে?”
“মাথা গলিয়ে দিয়ে দেখুন, ভিতরে অনেক জায়গা।”
বিজয়বাবুও দেখলেন, তাই। মসৃণ পথ নেমে গিয়েছে ঢালু হয়ে। অন্ধকার। বিজয়বাবু অবশ্য সবই দেখতে পাচ্ছেন।
হঠাৎ বঙ্কা হাত চেপে ধরে বিজয়বাবুকে থামাল, “ঝিঝির ডাক শুনতে পাচ্ছেন কর্তা?”
“হ্যাঁ।”
“এসে গিয়েছি। ধীরে পা টিপে টিপে চলুন।”
সামনেই গুহার রাস্তাটা একটা বাঁক নিয়েছে। তারপরই আশ্চর্য আলোকোজ্জ্বল ঘর। আলোর কোনও উৎস নেই, তবু ঘর আলোয় আলোময়। এসব স্বপ্নের প্রযুক্তি ওদের হাতে। ওরা শত্রু না বন্ধু তা এখনও বুঝতেই পারছেন না বিজয়বাবু। কিন্তু তাঁর হাতে কোনও বিকল্পও নেই।